সম্প্রতি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে আরব লীগ ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) জরুরি শীর্ষ বৈঠকে গাজা ও লেবাননে ইসরাইলি গণহত্যা অভিযানের ধ্বংসাত্মক ফলাফল নিয়ে পর্যালোচনা হয়েছে।
চলতি সপ্তায় গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের ৪০০ দিন অতিবাহিত হলো। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এ আগ্রাসনে। তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
ইরানের অনুরোধে আয়োজিত এই শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন বিশ্বের ৫৮টি মুসলিম দেশের নেতারা। এতে অংশ নিয়েছেন ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ রেজা আরেফ, ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদসহ আরো অনেক খ্যাতনামা মুসলিম নেতারা। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান ছিলেন এই সম্মেলনের মেজবান।
সম্মেলনের সমাপনী বৈঠকের ইশতেহারে পূর্ব বায়তুল মুকাদ্দাসকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়া হয়। এ অঞ্চলের ওপর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে মৌলিক ও রেড-লাইন বা লাল সীমানা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বায়তুল মুকাদ্দাসের ইহুদিকরণ ও সেখানে দখলদারিত্বের ইসরাইলি পদক্ষেপও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে ওই ইশতেহারে। ওই ইশতেহারে এটাও বলা হয়েছে যে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্ব জোরদারের বিষয়ে ইসরাইলি শাসকগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত অগ্রহণযোগ্য ও অবৈধ। এ ধরনের সিদ্ধান্ত জাতিসঙ্ঘের নানা ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী।
মুসলিম দেশগুলো গাজায় ও লেবাননে ইসরাইলি সহিংস আচরণ জোরদারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে একে নৃশংস অপরাধযজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছে। ইসরাইলের পক্ষ থেকে ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। এছাড়া হাজার হাজার ফিলিস্তিনির নিখোঁজ হওয়া এবং ইসরাইলি কারাগারগুলোতে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন ও তাদের সাথে ইসরাইলের অবমাননাকর আচরণেরও নিন্দা জানানো হয়। আরব ও মুসলিম দেশগুলো এই সম্মেলনে লেবাননের প্রতি পরিপূর্ণ বা সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে। দেশটির নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও নাগরিকদের কল্যাণের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার কথা ঘোষণা করেছে।
একই ইশতিহার বা বিবৃতিতে গাজা ও লেবাননে যুদ্ধ-বিরতি প্রতিষ্ঠা না হওয়ার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করার পাশাপাশি এ দুই অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাধ্যতামূলক প্রস্তাব পাস করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই ইশতেহারে ইসরাইলের সহযোগী সরকারগুলোর দ্বিমুখী নীতির নিন্দা জানিয়ে বলা হয়েছে, ইসরাইলকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে মনে করে ও ইসরাইলকে সহায়তা দিয়ে তারা নিজ নিজ পদক্ষেপগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাকে অত্যন্ত দুর্বল করেছে ও মানবীয় মূল্যবোধের ব্যাপারেও তাদের বিশেষ বাছাইকৃত নীতি বা পক্ষপাতমূলক অবস্থানকেও স্পষ্ট করেছে0।
সম্মিলিত দায়িত্ববোধ
ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ রেজা আরেফ এই সম্মেলনে দেয়া বক্তব্যে ফিলিস্তিনি ও লেবাননিদের ওপর ইসরাইলের জাতিগত নির্মূল অভিযান বন্ধে জাতিসঙ্ঘের ও বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এই ব্যর্থতার জন্য ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কোনো কোনো সরকারের জোরালো সমর্থনকে দায়ী করেছেন।
আরেফ এ বৈঠকে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞ বন্ধে মুসলিম ও আরব দেশগুলোকে জোরালো ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়ার আহ্বান জানান। আন্তর্জাতিক সমাজের কার্যকর হস্তক্ষেপের অভাবে এক্ষেত্রে এই দেশগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী রহ: বলেছিলেন, মুসলমানরা যদি এক বালতি করে পানি ঢালতো, তাহলে ইসরাইল ভেসে যেতো। তিনি এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য বিশ্ব-কুদস দিবস প্রবর্তন করেছিলেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনীও মুসলমানদের প্রথম কিবলার ইসরাইলের পরিচালিত ও যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট গণহত্যাসহ নানা অপরাধ বন্ধ করতে মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়ে এসেছেন। মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ না হলে খোদায়ি রহমত, সম্মান ও শত্রুর ওপর বিজয় সম্ভব নয় বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ও সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এই সম্মেলনে। তিনি গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধ করতে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের ও অবরুদ্ধ এ উপত্যকায় মানবীয় সহায়তা পাঠানো নিশ্চিত করারও আহ্বান জানান।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতিও এই সম্মেলনে বলেছেন, তার দেশ এক নজিরবিহীন সঙ্কটের সম্মুখীন ও দেশটির টিকে থাকা এখন হুমকির মুখে রয়েছে। কারণ ইসরাইল লেবাননের জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে।
তিনি আরো বলেছেন, ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত তিন হাজার লেবাননি নিহত ও ১৩ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছেন। শরণার্থী হয়েছেন ১২ লাখেরও বেশি। অর্থনৈতিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ৮৫০ কোটি ডলার যার মধ্যে রয়েছে এক লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়া ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর কৃষি খাতের মতো জীবন ধারণের মৌলিক বা প্রধান খাতগুলোর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি।
গণহত্যায় সহযোগিতা
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বলেছেন, ইসরাইল যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তা বন্ধের নানা মাধ্যম বা উপকরণ রয়েছে। কিন্তু এসব ব্যবহার না করা হলে তা হবে গণহত্যা অব্যাহত রাখতে সহযোগিতা করে যাওয়া।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ইসরাইল যদি আগ্রাসন বন্ধের আহ্বানে সাড়া না দেয়, তাহলে আগ্রাসন বন্ধের উপকরণগুলো ব্যবহার করা উচিত।
তিনি ইসরাইলি শাসকগোষ্ঠীকে অবৈধ সরকার হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এই অবৈধ সরকার গড়ে উঠেছে একদল নরঘাতক ও অপরাধীকে নিয়ে।
এই সম্মেলনে ইয়েমেনের প্রতিনিধি ও দেশটির রাজনৈতিক উচ্চ পরিষদের প্রধান মাহদি আলমাশাত্ব ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি সহায়তার পাশাপাশি ইসরাইলের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি ইসরাইলি নৃশংসতা উপেক্ষা করা হয় ও এমন কারো কাছ থেকে এ সঙ্কটের সুরাহার আশা করা হয় যারা ইসরাইলের প্রধান সহযোগী, তাহলে সবার জন্য কঠোর পরিণতি অপেক্ষা করছে।
এই সম্মেলনের মিজবান সৌদি যুবরাজ ফিলিস্তিনি ও লেবাননি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি ফিলিস্তিনি সরকারকে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান এবং আরো বেশি আগ্রাসী পদক্ষেপ না নিতে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানান।
আরব লীগের মহাসচিব আহমাদ আবুল গাইতও সৌদি যুবরাজের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে গাজা ও লেবাননে ইসরাইলের প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের নিন্দা জানান। তিনি বলেন, শব্দগুলো ফিলিস্তিনি জনগণের দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা তুলে ধরতে সক্ষম নয়।
ইসরাইল গাজার পর লেবাননেও যুদ্ধ ছড়িয়ে দেয়ায় এর নিন্দা জানান জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গাজা যুদ্ধের ট্র্যাজেডি অসহনীয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি ফিলিস্তিনে মানবীয় সহায়তা পাঠানোর ওপর জোর দেন।
আন্তর্জাতিক আরবীয় ও ইসলামী জোট গড়ার আহ্বান
এ সম্মেলন উপলক্ষে পাঠানো এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস গাজা ও লেবাননে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞ বন্ধের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আরবীয় ও ইসলামী জোট গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।
সূত্র : পার্সটুডে
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: