লেবাননে বিদ্যুৎ সংকট: জেনারেটরে নির্ভরতায় ক্যানসার বেড়েছে ৩০ শতাংশ

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৪১

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গত পাঁচ বছরে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিদ্যুৎ সংকটে বৈরুত ডিজেল জেনারেটরের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এতে সৃষ্ট বায়ুদূষণ এই ক্যানসার ঝুঁকি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে গবেষণাটি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের (এইউবি) বিজ্ঞানীদের পরিচালিত ওই গবেষণায় দেখা গেছে, লেবাননের রাজধানী ডিজেল জেনারেটরের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় গত পাঁচ বছরে ক্যানসার আক্রান্তের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়েছে। ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষায় ক্যানসার ধরা পড়ার হার ক্রমেই বাড়ছে।

২০১৯ সালে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর থেকে লেবাননের শহরগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ডিজেল জেনারেটর। এসব শহরের রাস্তায় বের হলেই কানে আসে জেনারেটরের শব্দ, পোড়া তেলের গন্ধ। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব হলো, বাসিন্দাদের এই দূষিত বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

লেবাননের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাকাসেদ। সেখানকার বায়ু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাতাসে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি প্রতি ঘন মিটারে ৬০ মাইক্রো গ্রাম। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের (১৫ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার) চার গুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, এই মানের বায়ুতেও বছরে ৩–৪ দিনের বেশি শ্বাস নেওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

বায়ুমণ্ডলীয় রসায়নবিদ ও গবেষণা দলটির প্রধান নাজাত সালিবা বলেন, ‘ফলাফল উদ্বেগজনক। এরপরও জেনারেটর–মালিক এবং জ্বালানি আমদানিকারকেরা শহরের অভ্যন্তরে ডিজেল জ্বালিয়ে মানুষের শ্বাসরোধ করে অর্থ উপার্জন করছেন।’

সর্বশেষ ২০১৭ সালে বৈরুতের বায়ুমণ্ডল থেকে এইউবি নানা উপাদান সংগ্রহ করেছিল। তখনকার চেয়ে এখন বায়ুমণ্ডলে কার্সিনোজেনিক (ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান) দূষণের মাত্রা বৈরুতের তিনটি এলাকায় দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি অদূর ভবিষ্যতে প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে।

নাজাত সাবিলা বলেন, ক্যানসার বৃদ্ধির সঙ্গে ডিজেল জেনারেটর ব্যবহারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। আমরা ডিজেল জেনারেটর থেকে নিঃসরিত ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান হিসাব করেছি। এর মধ্যে কিছু কার্সিনোজেন উপাদান ১এ ক্যাটাগরির।

বৈরুতের ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা এখন অনুমান করছেন, ২০২০ সাল থেকে সাধারণ ক্যানসারের হার প্রতি বছর ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণে (যদিও এখন পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই) দেখা গেছে, কমবয়সীরা ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। আর এই পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে।

জাতীয় গ্রিডে দৈনিক লোডশেডিং থাকে। লোডশেডিংয়ের এই তিন–চার ঘণ্টা জেনারেটরগুলো চলে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ২০১৯ সালে। এরপর থেকে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ খাত দ্রুতই ধসে পড়ে। সংকট মোকাবিলায় ডিজেল জেনারেটরে নির্ভরতা বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের আগস্টে বৈরুতের বাণিজ্যিক বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে দুই শতাধিক নিহতের ঘটনার পর লেবাননের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে।

ক্যানসার চিকিৎসা কেমোথেরাপি নেওয়ার মতো সামর্থ্যও অনেক মানুষের নেই। ক্যানসার সাপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হানি নাসার বলেন, এখানে ক্যানসার রোগীদের সবচেয়ে বড় সমস্যা টাকা। সরকারি খাতে গড় মাসিক বেতন প্রায় ১৫০ ডলার। কেমোথেরাপি নিতে চাইলে এই টাকায় কিছুই হবে না।

২০২৩ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রতিবেদনে দেখা যায়, লেবাননে বিদ্যুৎ সংকট রয়েছে, বেশির ভাগ মানুষ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পায় না। এরপরও লেবানন সরকার ক্রমাগত তেলনির্ভর সব নীতি গ্রহণ করেছে। যেখানে সারা বিশ্বে বহু দেশ নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, সরকারের নীতি নির্ধারণে ডিজেল আমদানিকারকেরা প্রভাব খাটায়। ফলে সরকারের অনেক নীতিই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না। এর প্রধান কারণ হলো, এসব কোম্পানিতে রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ রয়েছে।

২০১৭ সালে লেবানন সরকার শুধু জেনারেটরের জ্বালানি সরবরাহের জন্য প্রায় ৯০ কোটি ডলার মূল্যের ডিজেল আমদানি করে। ২০২২ সাল নাগাদ এই আমদানি ব্যয় বেড়ে ১৯০ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি লেবানন সরকারের নেই। ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেতে শর্ত পূরণও করতে পারছে না। এরই মধ্যে সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বাজেট স্থগিত করেছে। এর জন্য ভুগতে হচ্ছে সাধারণ নাগরিকদের।

গবেষক সালিবা বলেন, লেবানন একটি ‘বড় দুষ্ট চক্রে’ আটকা পড়েছে। আমরা এখন খুব দরিদ্র দেশ, তাই আমরা দাতাদের কাছে টাকা চাই। কিন্তু গত ১০ বছরে সরকারের সমস্ত খাতে প্রবণতা হলো—শুধু টাকা নেওয়া ও নির্দিষ্ট খাতে কিছু কাজ করার পর পরিচালনার জন্য বরাদ্দ না দিয়ে সেটি ফেলে রাখা। প্রকল্পটি চালু রাখার কোনো চেষ্টা বা ইচ্ছা আর দেখা যায় না।’

২০২০ সালে গ্রিনপিস পরিচালিত একটি সমীক্ষা দেখা যায়, ২০১৮ সালে বায়ু দূষণের কারণে লেবাননে ২ হাজার ৭০০ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বায়ু দূষণের কারণে লেবাননে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। যা দেশটির মোট জিডিপির ২ শতাংশ।

এদিকে লেবাননের প্রাপ্তবয়স্কদের আনুমানিক ৭০ শতাংশ মানুষ নিয়মিত ধূমপান করে এবং ৩৮ শতাংশ ধূমপান করেন প্রতিদিন।

এইউবির সভাপতি এবং ফুসফুস–ঘাড়ের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. ফাদলো খুরি বলেন, বৈরুতে যা ঘটছে তা সামগ্রিক পরিস্থিতির ফলাফল।

এই গবেষক আরও বলেন, ‘এইউবির গবেষণা এবং গাণিতিক মডেলিংয়ে দেখা গেছে, লেবাননের মানুষ প্রতিদিন যেসব বায়ুবাহিত কার্সিনোজেনের শিকার হয় তার সবই আসে ডিজেল জেনারেটর থেকে।’



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: