ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধে ইসরাইলকে নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহর থেকে আইসিজে এই আদেশ দেয়। গাজায় ইসরাইল গণহত্যা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ দায়ের করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। এই অভিযোগের শুনানির পর শুক্রবার আইসিজে থেকে এই সিদ্ধান্ত আসে।
প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওই মামলা দায়ের করা হয়। হেগে অবস্থিত আইসিজে দুই পক্ষেরই বক্তব্য শুনেছে। এতে ইসরাইল গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত দেশটিকে গণহত্যা বন্ধের নির্দেশ দিলো আইসিজে। যদিও আন্তর্জাতিক এই আদালতের কোনো দেশকে তার রায় মানতে বাধ্য করার কোনো সুযোগ নেই। তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই রায় ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে।
আদালত বলেছে, এই মামলায় রায় দেয়ার এখতিয়ার তার রয়েছে। আদালত ইসরাইলকে গাজা উপত্যকায় গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি এক মাসের মধ্যে এ নিয়ে রিপোর্ট জমা দিতে বলেছে আইসিজে।
সাময়িক এই রায়ে ইসরায়েলকে ছয়টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের আদেশ দিয়েছেন বিশ্ব আদালত।
আইসিজের ৬ নির্দেশনা
১। গাজায় গণহত্যা প্রতিরোধে ইসরায়েলকে নিজেদের ক্ষমতার মধ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২। ইসরায়েলি বাহিনী যেন গাজায় গণহত্যা না চালায় সেটা ইসরায়েলকে নিশ্চিত করতে হবে।
৩। গাজা উপত্যকায় গণহত্যার প্রত্যক্ষ উসকানি প্রতিরোধ ও এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে ইসরায়েলকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪। গাজা উপত্যকায় মানবিক ত্রাণ সহায়তা প্রবেশ নিশ্চিত করতে ইসরায়েলকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫। গণহত্যার যে অভিযোগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উঠেছে তার সব প্রমাণ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬। আদালতের আদেশ দেওয়ার পর কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা জানিয়ে এক মাসের মধ্যে ইসরায়েলকে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
এই রায়ের পর সন্তোষ প্রকাশ করেছে ফিলিস্তিন। এর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রতিক্রিয়ায় বলে, আমরা আইসিজে’র রায়কে স্বাগত জানাই। এই রায় প্রমাণ করে যে, কোনো রাষ্ট্রই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি আদালতের সিদ্ধান্তকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, এই রায় ইসরাইলকে বিচ্ছিন্ন করতে এবং গাজায় তাদের অপরাধ প্রকাশ্যে আনতে ভূমিকা রাখবে। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, আদালতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আমরা ইসরাইলকে বাধ্য করার আহ্বান জানাই।
এদিকে মামলা করা দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এই রায়কে ‘বিজয়’ বলে আখ্যায়িত করেছে। আইসিজে’র এই দ্রুত রায়ের জন্য দেশটি আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। দেশটি আশা প্রকাশ করেছে যে, ইসরাইল এখন এই রায় মানতে বাধ্য হবে। এই রায় ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা গাজায় ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ চালিয়ে যাবে।
এদিকে ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন গভির ইসরাইলের বিরুদ্ধে এই রায় দেয়ায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নিন্দা করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থাটিকে ইসরাইলবিরোধী অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, হেগের ইহুদি-বিরোধী আদালতের এই রায় আগে থেকেই জানা ছিল। এই রায় প্রমাণ করে যে, এই আদালত ন্যায়বিচার চায় না, বরং ইহুদিদের নিপীড়ন চায়। তারা হলোকাস্টের সময় নীরব ছিল এবং আজও তারা ভণ্ডামি চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভণ্ডামি এখন আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৭ই অক্টোবর ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা ইসরাইলে আকস্মিকভাবে ঢুকে হামলা চালিয়ে ১২০০ মানুষকে হত্যা করে এবং অন্তত ২৫০ জনকে জিম্মি করে নিয়ে যায়। ওইদিন থেকেই গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরাইল। এখনও গাজায় অভিযান অব্যাহত রেখেছে দেশটি। এতে ২৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছে ৭০ হাজার মানুষ।
এমন অবস্থায় গাজায় গণহত্যার অভিযোগ আমলে নিয়ে ইসরাইলের সামরিক অভিযান বন্ধসহ নয়টি ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক এই আদালতে আবেদন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আইসিজের ১৭ জন বিচারকের প্যানেল শুক্রবার ওই মামলার রায় দেন। এই প্যানেলে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরাইলের একজন করে বিচারকও ছিলেন।
শুক্রবার প্রায় ঘণ্টাখানেক শুনানির পর আদালত হেগের স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় এ রায় দেয়। গণহত্যা চালানোর অভিযোগে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইসরাইল এর আগে বলেছিল যে, দক্ষিণ আফ্রিকা সত্য বিকৃত করছে। তাদের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকরা নয়, তাদের লক্ষ্য শুধু হামাসের যোদ্ধারা।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: