ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব শক্ত অবস্থান নিতে পারে না কেন?

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:২৫

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি


মুসলিম প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন এবং নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসছে। তবে তাদেরকে বড় ধরনের সংকট এলে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরায়েলের সাথে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোন ভূমিকা নিতে পারে না।

এবার গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিতে ভয়াবহ হামলার পর নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উভয় পক্ষের আক্রমণে বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের সর্বাত্মক সমর্থনে এগিয়ে এসেছে।

এর বিপরীতে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে ইরান ছাড়া আর কোন দেশকেই উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না। বরং কোন কোন মুসলিম দেশের প্রতিক্রিয়া ছিলো একেবারেই নখদন্তহীন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মুসলিম বিশ্বের জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়া অসম্ভব।

সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ বলছেন যে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া বা শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো পশ্চিমাদের অবস্থান।

তিনি বলেন, 'ইসরায়েল একা প্রতিপক্ষ হলে এতদিনে পরিস্থিতি অন্যরকম দেখা যেত। তবে ইসরায়েলেও অনেকে শান্তি চায়। সে কারণে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের সাথে এখন তাদের যোগাযোগ হচ্ছে। এমন নানা কারণে মুসলিম বিশ্বের এমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।'


মুসলিম দেশগুলো এবার যা বলেছে

এবার ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস এমন সময় হামলা চালিয়েছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নিয়ে কাজ করছিলো সৌদি আরব ও ইসরায়েল। গত সেপ্টেম্বরে এ নিয়ে রিয়াদে এসে কথা বলে গেছেন মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারাও।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে আরব বিশ্বের আরেক প্রভাবশালী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত।

যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি সমঝোতা বা চুক্তি স্বাক্ষরের সফলতা অর্জন করতে চাইছে বাইডেন প্রশাসন। তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরু হওয়ার পর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে সৌদি আরব।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, তার দেশ ফিলিস্তিনি জনগণের একটি স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার রক্ষা, তাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা এবং ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি অর্জনের জন্য সবসময় তাদের পাশে থাকবে।

আরেক প্রভাবশালী আরব দেশ কাতার বরাবরই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিরোধী। দেশটি তাদের বিবৃতিতে পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েলকেই দায়ী করেছে। দেশটি ফিলিস্তিনের জন্য পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের আগের ভূখণ্ডকে সমর্থন করে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত হামাসের হামলার সমালোচনাও করেছে। এমনকি দেশটির বিবৃতিতে ইসরায়েলি নাগরিক জিম্মি করার বিষয়টি উঠে এসেছে। কিন্তু ইসরায়েলের প্রাণঘাতী হামলার বিষয়টি সেখানে আসেনি। বাহরাইন হামাসের হামলার সমালোচনা করেছে। আর কুয়েত ও ওমানের প্রতিক্রিয়া ছিলো অনেকটাই কৌশলী।

অন্যদিকে ইসরায়েলের সাথে ১৯৮০ সালেই চুক্তি করা মিসর উভয় পক্ষকে সংযত হতে বলেছে। মরক্কো অবশ্য গাজায় সামরিক হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সিরিয়া অবশ্য হামাসের হামলাকে বড় অর্জন বলেছে। হুতি নিয়ন্ত্রিত ইয়েমেনও হামাসকে সমর্থন দিয়েছে। আরব বিশ্বের বাইরে অনেকটা একই সুরে কথা বলেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো।

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিরোধে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট। ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে একেবারে শুরু থেকেই।


গণতন্ত্র নেই, তাই জনমতের প্রতিফলন নেই

বিবিসি প্রতিবেদনে বলেছে, গণতন্ত্র এবং প্রতিনিধিত্বশীল সরকার মুসলিম বিশ্বে খুবই কম এবং এ ধরনের দেশগুলোর সরকারকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় বলে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যাওয়ার সুযোগ তাদের নেই।

আবার ফিলিস্তিনে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন পিএলও, গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাসের পাশাপাশি আরেক সংগঠন হিজবুল্লাহকেও বিভিন্ন প্রভাবশালী মুসলিম দেশ সমর্থন দিয়ে থাকে বলে প্রচার আছে। যেমন হামাস ইরান-সমর্থিত বলে বর্ণনা করে পশ্চিমারা।

অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো প্রভাবশালী আরব দেশগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েলের সাথে তাদের সম্পর্ক জোরদার করেছে, যা অনেক ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের স্বার্থকে দুর্বল করেছে বলেও মনে করেন অনেকে।

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছিলেন যে, মুসলিম বিশ্বে প্রভাবশালী আরব দেশগুলোর, কেউ কেউ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে আবার কেউ কেউ স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় আছে।

তিনি বলেন, 'নিজেদের ক্ষমতাকে তারা চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়। সংগত কারণেই তারা হয়তো মনে করে পপুলার সেন্টিমেন্ট যাই হোক ইসরায়েলকে ঘাঁটানো তাদের ঠিক হবে না। এ কারণেই তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত দেখা যায় না।'

জার্মানি ভিত্তিক বিশ্লেষক ডঃ মারুফ মল্লিক বলেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী আরব বিশ্বে গণতন্ত্র বা নির্বাচনের বালাই নেই।ইসরায়েলের সাথে সমঝোতা বা ভারসাম্য রক্ষা করে চলা তাদের জন্য জরুরি।


ক্ষমতা হারানোর ভয়

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসক পরিবারগুলো ক্ষমতার প্রশ্নে কোন ধরনের আপোষ কখনোই করে না। আবার এসব দেশে গণতন্ত্র বা জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থাও কাজ করে না। তারপরেও অনেকেই মনে করেন লিবিয়া ও সিরিয়ার ঘটনার পর আরব দেশগুলোর রাজপরিবারগুলো নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন।

সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, মুসলিম দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্য নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার কারণেই ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারছে না। বেশিরভাগ দেশেই দুটি প্রবণতা—জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে বেশি কিন্তু সরকারগুলোর কথায় জোর কম। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার জটিলতার কারণেই তারা শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারে না।

আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচন করার সুযোগ আছে ইরানে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বলয়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল শক্ত অবস্থান নিয়ে আসছে।

অন্যদিকে তুরস্ক বিবৃতিতে শক্ত ভাষা ব্যবহার করলেও ন্যাটোর সদস্যপদসহ বেশ কিছু বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে কৌশলী ভূমিকা নিতে হচ্ছে। এর বাইরে অন্য দেশগুলোর সরকার ও জনগণের চিন্তার মধ্যেই প্রচুর ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে বলে মনে করেন কবির।

তিনি বলেন, এছাড়া অনেক দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন সরে যাচ্ছে। ফলে তাদের জন্য ইসরায়েল সিকিউরিটি গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করছে। ইরান ছাড়া বেশিরভাগ দেশেরই পাশ্চাত্য নির্ভরতা অনেক বেড়েছে। সে কারণে তাদের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়।


পশ্চিমাদের চটানোর ভয়

বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিক বলছেন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্র নেই এবং সে কারণে এসব দেশের সরকারকে সমঝোতা করে চলতে হয়। তিনি বলেন, 'পশ্চিমাদের চটিয়ে কেউ নিজের ক্ষমতাকে দুর্বল করতে চায় না। মিসর, তিউনিসিয়ার মতো দেশও এর বাইরে নয়। সবাই জানে সোচ্চার হলেই চাপ আসবে। বরং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ইসরায়েলের সাথে তাদের সমঝোতা জরুরি।'

একই কারণে ওআইসি বা আরব লীগও চুপচাপ থাকে বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি তার মতে রাজতন্ত্রের বাইরে থাকা দেশগুলো- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সোচ্চার হওয়ার মতো প্রভাবই নেই।

যদিও এ নিয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ শোনা যায় বিভিন্ন মহল থেকে। অনেকে মনে করেন ইসরায়েলকে ঘিরে আরব দেশগুলোতে চিন্তার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এসেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে। আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ট্রাম্পের ভূমিকা আর ওই অঞ্চলে ইরানের সাথে বিরোধিতার কারণেই অনেক আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িয়েছে।

এসব কিছুই মূলত ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বকে শক্ত অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বল করে রেখেছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।


সূত্র: বিবিসি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: