ফাইল ছবি
হিমালয়ের বুকে নতুন ‘জল বোমা’ তৈরি করছে চীন। এর জেরে বন্যা এবং খরায় কয়েক লাখ ভারতীয়ের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে আগামী দিনে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০০৩ সালে ইয়াংজি নদীর ওপর নির্মিত বিশ্বের বৃহত্তম ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশাসন। প্রায় ৩২ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে তৈরি হওয়া ওই বাঁধটির প্রযুক্তি নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। পশ্চিমা ভূ-বিজ্ঞানীদের একাংশের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট বাঁধটি যেভাবে নদীর পানি এবং তার গতি নিয়ন্ত্রণ করছে তাতে দৈনিক ০.০৬ মাইক্রোসেকেন্ড কমেছে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি। পরিবেশবিদদের দাবি, আগামী দিনে এর জেরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এর প্রভাব সহ্য করতে হতে পারে সমগ্র পৃথিবীকেই।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো- উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর ঠিক একই ধরনের আরও একটি বাঁধ তৈরি করছে চীন সরকার।
জানা গেছে, আকারে এটি হবে ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধের প্রায় তিন গুণ। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্যণ করেছেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু। বেইজিংয়ের প্রস্তাবিত বাঁধকে ভারতের জন্য ‘জল বোমা’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে নয়াদিল্লির শুরু হয়েছে প্রবল টানাপড়েন।
২০২৪ সালে অরুণাচলে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) থেকে কয়েক মাইল দূরের ওই প্রস্তাবিত বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কথা ঘোষণা করে চীন। বেইজিং অধিকৃত তিব্বতে তা বাস্তবায়িত হওয়ার কথা রয়েছে। চীন সরকার অবশ্য ‘পৃথিবীর ছাদ’কে তাদের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বলে থাকে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির জন্য ১৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় বরাদ্দ করেছে চীন।
তিব্বতের কৈলাস পাহাড়ের চেমায়ুংডুং হিমবাহ থেকে জন্ম হওয়া ব্রহ্মপুত্রের চীনে আলাদা পরিচয় রয়েছে। মান্দারিনভাষীদের কাছে সেটি ইয়ারলুং সাংপো নদী। অরুণাচলের কাছে তার ওপর যে বাঁধটি বেইজিংয়ের ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করতে যাচ্ছেন, তার নাম ‘গ্রেট বেন্ড’। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে সেখান থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ পাবে চীন সরকার। সে কারণে এর জন্য পানির মতো অর্থ খরচ করতেও রাজি জিনপিং প্রশাসন।
চলতি বছরের গোড়ায় তিব্বতসফর করেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সাধারণভাবে তাঁ খুব একটা বেইজিংয়ের বাইরে বের হতে দেখা যায় না। সে কারণে হঠাৎ তার পা ‘পৃথিবীর ছাদে’ গিয়ে পড়ায় তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। লাসার অনুষ্ঠানে প্রস্তাবিত বাঁধনির্মাণের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেন শি জিনপিং। তিনি বলেন, “আমজনতার স্বার্থে পদ্ধতিগতভাবে প্রকৌশলগত বিষয়গুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”
এর পরই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কাজ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করে।
সম্প্রতি ‘ওপেনসোর্স’ থেকে প্রাপ্ত কিছু ছবি এবং ভিডিও পর্যালোচনা করে চীনের প্রস্তাবিত ‘গ্রেট বেন্ড’ বাঁধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিএনএন। গণমাধ্যমটির দাবি, অরুণাচল সীমান্তের কাছে নির্মাণকাজ জোরকদমেই শুরু করেছে বেইজিং। গত জুলাই থেকে চলছে বাঁধের সঙ্গে যুক্ত রাস্তার কাজ। এছাড়া সেতুনির্মাণ এবং টেলি যোগাযোগ সম্প্রসারণের চেষ্টাও চালাচ্ছেন চীনের ইঞ্জিনিয়াররা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাজ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বাঁধনির্মাণের জন্য ব্রহ্মপুত্রের একটি বিশেষ ঢালু জায়গা বেছে নিয়েছে চীন। ওই এলাকায় ভূমি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় বইছে নদী। যদিও কিছু দূর গিয়ে প্রায় দু’হাজার মিটার গভীরে লাফিয়ে পড়ছে পানি। নদীখাতের এই খাড়া ঢালটিকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগাতে চাইছেন বিইজিংয়ের ইঞ্জিনিয়াররা। তাদের দাবি, বছরে ৩০ হাজার কোটি কিলোওয়াট-ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের আদর্শ জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে। ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধের প্রায় তিন গুণ বেশি বিদ্যুৎ ‘গ্রেট বেন্ড’ দেবে বলে মনে করছেন তারা।
সরকারি বিবৃতিতে চীন অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে, কয়েক দশকের বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং জরিপের পর বাঁধের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করবে। এর ফলে কমবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার। ফলে হ্রাস পাবে বায়ুদূষণ এবং গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন। এর জেরে ভারত ও বাংলাদেশের নিম্ন অববাহিকায় বন্যার প্রকোপ কমানো যাবে। যদিও বেইজিংয়ের এই আশ্বাস বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। আর তাই প্রস্তাবিত ‘গ্রেট বেন্ড’কে কেন্দ্র করে বেড়েই চলেছে নয়াদিল্লির রক্তচাপ।
চলতি বছরের গোড়ার দিকে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু। তার কথায়, “চীনকে বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ ওরা মুখে এক এবং কাজে আরেক। ওই বাঁধ তৈরি হলে আমাদের সিয়াং এবং ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যেতে পারে। প্রকল্পের কাজ শেষে হলে যখন-তখন পানি ছাড়ার ক্ষমতা থাকবে বেইজিংয়ের হাতে। তখন তো পানির স্তর বেড়ে গেলেও ওরা সেটা ছেড়ে দেবে। এতে সিয়াং বেল্ট ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। সেখানকার সম্পত্তি, জমি এমনকি মানুষের জীবন পর্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।”
ভারতের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সমস্যার জায়গা হল, আন্তর্জাতিক জলবণ্টন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি চীন। ফলে আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রবাহ বদল হলে বিশ্বমঞ্চে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারবে না নয়াদিল্লি। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক জলপথের অ-নৌকা চলাচল সংক্রান্ত একটি আইন পাশ করে জাতিসংঘ। এর লক্ষ্য ছিল আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি। চীন অবশ্য এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল।
অতীতে বেশ কয়েকবার নদীর জলপ্রবাহ আটকে দেওয়ার অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে চীন। উদাহরণ হিসেবে ২০২১ সালের কথা বলা যেতে পারে। ওই বছর পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই মেকং নদীর জলপ্রবাহ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয় বেইজিং। পরে এ নিয়ে বিতর্ক তীব্র হলে সরকারি স্তরে ব্যাখ্যা দেয় চীনা প্রশাসন। বলা হয়, বিদ্যুতের লাইন রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য তিন সপ্তাহের জন্য ওটা করতে হয়েছিল। স্থায়ীভাবে কোনও নদীর জলপ্রবাহ আটকানো হয়নি।
কিন্তু চীনের ওই পদক্ষেপে সমস্যার মুখে পড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ। মেকং নদী কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের ওপর দিয়েও বয়ে গেছে। এই দেশগুলোতে সংশ্লিষ্ট নদীটির জলস্তর ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন ও জীবিকা প্রভাবিত হয়েছিল।
এছাড়া ২০১৭ সালেও বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে নদীর পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। ওই বছরের ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই ফুঁসে উঠে আসামের বিস্তীর্ণ এলাকা ভাসিয়ে দেয় সিয়াং নদী। ভারতের সঙ্গে পানি সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগির চুক্তি থাকা সত্ত্বেও আসন্ন বন্যা নিয়ে দিল্লিকে কোনও সতর্কতা দেয়নি চীনা সরকার। সিয়াং নদীর উৎপত্তিও চীন অধিকৃত তিব্বতে হওয়ায় সেখানে এর ওপর কোনও বাঁধ আছে কি না, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি।
২০১৭ সালে বন্যার সময় চীন থেকে সিয়াংয়ের পানিতে ভেসে আসে বহু দূষিত পদার্থ। এ নিয়ে বেইজিংকে প্রশ্ন করা হলেও কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। অরুণাচল সীমান্ত লাগায়ো ব্রহ্মপুত্রের ওপরের বাঁধ আবার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় তৈরি করছে চীন। কম্পনের জন্য বর্ষার সময় বাঁধটি ভেঙে গেলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০২৪ সালে প্রস্তাবিত বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বিষয়টি সরকারিভাবে ঘোষণা করে চীন। এর মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তিব্বত। রিখটার স্কেলে যার তীব্রতা ছিল ৬.৮। জনবহুল এলাকায় ওই কম্পনের জেরে মৃত্যু হয় ১২৬ জনের। গুরুতর আহতাবস্থায় আরও ১৮০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল।
চীনের এই প্রকল্প নিয়ে তাই নয়াদিল্লিকে সতর্ক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টার্ন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অধ্যাপক ড্যারিন ম্যাগি। তিনি বলেন, ‘‘এটা একটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেটা ভারতকে যখন-তখন বিপদে ফেলতে পারে। তবে যে কঠিন ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা হচ্ছে সেটা বুমেরাংও হতে পারে।”
অন্যদিকে, এ ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তিনি জানিয়েছেন, জাতীয় স্বার্থে পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। এর জন্য আগামী দিনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও এতে নয়াদিল্লি কোনও ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাব দেখাবে বলে মনে করেন না দুঁদে কূটনীতিক থেকে সাবেক সেনাকর্তাদের কেউই।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: