যে গ্রামে জুতা পরা নিষিদ্ধ

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৬ জুন ২০২৩ ০৫:২৫

যে গ্রামে কেউ জুতা পরে না যে গ্রামে কেউ জুতা পরে না

 

এই যুগে এসে এটা ভাবতে অবাক লাগলেও ভারতের একটি গ্রামের সব বাসিন্দা আসলেই খালি পায়ে থাকে, তারা কোনো ধরনের জুতা পরে না। এমনকি তাদের বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকার হলেও তারা খালি পায়েই যাতায়াত করে। খবর বিবিসি।

শুধু এটাই নয়, পরিবারের কেউ যদি অসুস্থ হয়, তাহলেও তারা হাসপাতালে যায় না। আর কোনো কারণে যদি তাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার দরকার হয় বা অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার হয় তাহলে তারা বাইরের কোনো খাবার এমনকি পানিও পান করে না।

এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও, এরকমই একটা গ্রাম রয়েছে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপাতি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামের নাম ভেমানা ইন্দলু।

এই গ্রামের বাসিন্দারা জানায় যে, এটা তাদের অনেক পুরনো ঐতিহ্য।

গ্রামবাসীরা বলেন যে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যখন গ্রামে প্রবেশ করেন তার আগে নিজেও জুতা খুলেই প্রবেশ করেন।

গ্রাম প্রধান ইরাব্বা বলেন, এই গ্রামে আমাদের সম্প্রদায় এসে বসবাস শুরু করার সময় থেকেই এই রীতি চলে আসছে।

তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা যখন বাইরে যাই, ফিরে এসে আমরা আগে গোসল করি, তারপর বাড়িতে ঢুকি ও খাবার খাই। আমি অনেকবার আমার গ্রামের বাইরে গিয়েছি। একবার আদালতের একটি কাজে আমাকে পাঁচ দিন গ্রাম থেকে বাইরে থাকতে হয়েছিল। যেখানে আমি ছিলাম, সেখানকার কোনো খাবার আমি স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।’

ইরাব্বা বলেন, ‘৪৭ বছর ধরে আমাকে আদালতের কাজের জন্য বাইরে যেতে হয়। কিন্তু আমি কখনোই বাইরে গিয়ে পানি ছাড়া আর কিছুই পান করি না। পান করার জন্য পানি আমি বাড়ি থেকে নিয়ে যাই এবং সেই পানিই পান করি। বাইরে থেকে পানি পান করার প্রশ্নই উঠে না। এমনকি আমরা বাইরে খাবারও খাই না।’

অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপাতি জেলার পাকালা মান্দাল এলাকার একটি গ্রাম ভেমানা ইন্দলু। এখানে ২৫টি ঘর আছে যার বাসিন্দা মোট ৮০ জন মানুষ। এই গ্রামে মোট ৫২ জন ভোটার রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা কয়েক জন স্নাতক শেষ করেছেন। এখানকার মানুষ খুব একটা শিক্ষিত নয় এবং তারা কৃষির ওপরই নির্ভর করে।

যাই হোক, মজার জিনিস হচ্ছে, এদের আত্মীয়-স্বজন যারা এই গ্রামে দেখা করতে আসেন তাদেরকেও এই রীতি মেনে চলতে হয়।

মহেশ নামে এক ব্যক্তি যিনি এই গ্রামে বেড়াতে এসেছেন, তিনি জানান যে, তার বোনের বিয়ে হয়েছে এই গ্রামে।

মহেশ বলেন, ‘মনে হয় যে এই গ্রামের সব মানুষই আমার আত্মীয়। আমরা যখনই গ্রামে আসি, এসব রীতি মেনে চলি। কিন্তু যখন আমরা আমাদের গ্রামে থাকি, তখন আবার আমাদের নিজেদের রীতি মেনে চলি।’

মহেশ আরও বলেন, ‘গ্রামের প্রবেশের আগেই আমরা জুতা খুলে ফেলি। কোনো বাড়িতে যদি আমাদের ঢুকতে হয় তাহলে তার আগে গোসল করতে হয়। আপনি গেলেও এই গ্রামে প্রবেশ করতে পারবেন না।’

এই গ্রামের শিক্ষিত মানুষেরাও এই রীতি মেনে চলে। এই গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে যে তারা `পালভেকারি’ গোত্রের। পালভেকারি মূলত তামিল নাড়ুর কৃষক সম্প্রদায় বা গোত্র।

অন্ধ্র প্রদেশে তাদেরকে নিম্নগোত্রভূক্ত মনে করা হয়। এই গ্রামের সব বাসিন্দা একই গোত্রের। তারা গ্রামের বাইরে কোন আত্মীয়তা করলেও একই গোত্রের মানুষদের সঙ্গেই করে থাকে।

গ্রামের মানুষ প্রাচীন মন্দিরে গিয়ে পূজা-অর্চনা এবং অন্যান্য রীতি-নীতি পালন করে থাকে। গ্রামে তারা নরসিংহ স্বামী ও গঙ্গা মায়ের পূজা করে। তারা বিশ্বাস করে যে, দেবতাই সব কিছুর খেয়াল রাখবেন। যার কারণে এই গ্রামের মানুষ কখনো হাসপাতালে যায় না।

গ্রামের প্রধান ইরাব্বা বলেন, ‘আমাদের যদি সাপে কামড়ও দেয়, আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের দেবতা সেটি আরোগ্য করবেন। আমরা কোনো হাসপাতালে যাই না। আমরা সাপের পাহাড় প্রদক্ষিণ করি। আমরা নিম গাছ প্রদক্ষিণ করি। আমরা হাসপাতালে যাই না।’

`আমাদের দেবতাই আমাদের খেয়াল রাখেন। আমরা অসুস্থ হলে মন্দির প্রদক্ষিণ করি। এটা করলে দুই দিনের মধ্যে আমাদের রোগ সেরে গিয়ে আমরা আবার সুস্বাস্থ্যবান হয়ে উঠি। এটাই আমাদের ঐতিহ্য।’

এই গ্রামের যে শিশুরা স্কুলে যায় তারাও জুতা পরে না এবং স্কুল থেকে যে দুপুরের খাবার দেওয়া হয়, সেটাও তারা খায় না। তারা যদি বাইরের কাউকে স্পর্শ করে তাহলে গোসল না করে বাড়িতে প্রবেশ করে না।

পাশের গ্রামের এক বাসিন্দা ববিতা বলেন, ওই গ্রামের নারীদের মধ্যে কেউ গর্ভবতী হলেও তারা হাসপাতালে যায় না। সবকিছু বাড়িতেই হয়।

ববিতা বলেন, `স্কুলগামী শিশুরাও সেখানে দেওয়া দুপুরের খাবার খায় না। তারা খাবার খেতে বাড়িতে ফেরে, খাবার খেয়ে আবার স্কুলে যায়।’

দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের এই গ্রামে প্রবেশ করা নিষেধ। এমনকি এই গ্রামের মানুষ দলিত সম্প্রদায়ের কারো সঙ্গেও কথাও বলে না।

নারীদের ঋতুস্রাবের সময়ে গ্রামের বাইরে থাকতে হয়। গ্রামের মানুষ মিডিয়া থেকেও নিজেদেরকে দূরে রাখে।

বাবু রেড্ডি যিনি গ্রামের রেশনের দোকান চালান তিনি বলেন, এই গ্রামে যে আসবে যে যদি সরকারি কর্মকর্তা এমনকি পার্লামেন্ট সদস্যও হয়ে থাকেন, তাহলেও তাকে গ্রামের বাইরে জুতা খুলে তারপর প্রবেশ করতে হবে।

‘নিম্ন বর্ণের মানুষদের এই গ্রামে প্রবেশের অনুমতি নেই। গ্রামের মানুষ এসব বর্ণের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে না, স্পর্শও করে না। প্রতি মাসে ঋতুস্রাবের সময় নারীদের অন্তত পাঁচ দিন গ্রামের বাইরে থাকতে হয়’ তিনি বলেন।

‘গ্রামের বাইরে ঋতুস্রাবের সময় নারীদের থাকার জন্য কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। রাত-দিন তাদেরকে ওই একই কক্ষে থাকতে হয়। গ্রামের মানুষ সব ধরণের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পায়। আমরা তাদের বাড়িতে গিয়ে রেশন দিয়ে আসি, তাদের রেশন অন্যদের থেকে আলাদা এবং শুধু তাদের কাছেই হস্তান্তর করা হয়।’

বিবিসি তিরুপাতি জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ভেঙ্কাটারামি রেড্ডির সঙ্গে কথা বলেছে ভেমানা ইন্দলু গ্রামের এসব রীতি-নীতি নিয়ে।

তিনি বলেন যে, তিনি গ্রামে একটি সচেতনতামূলক প্রচারণার আয়োজন করবেন এবং বাসিন্দাদের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: