শিশুরা যখন কান্নাকাটি করে বা কোনও কিছুর জন্য বায়না ধরে, তখন অভিভাবকরা প্রায়শই বাচ্চাকে চুপ করাতে হাতে মোবাইল বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক গ্যাজেট তুলে দেন। এই প্রবণতা আজকাল বেশ সাধারণ হয়ে উঠেছে। এটি শিশুকে সঙ্গে সঙ্গে শান্ত করে। এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলের মগ্ন থাকে শিশু। বাবা-মায়ের ব্যস্ততার ফাঁকে শিশুদের জগৎ গড়ে উঠেছে মোবাইলের ছবি ও ভিডিও কেন্দ্রিক, যে ভাষা, শব্দ বা দৃশ্যগুলির বাস্তবজীবনের প্রয়োগ বা অর্থ সম্পর্কে তার ধারণা জন্মায়নি। তাই আশপাশের জগৎ তাদের কাছে কোনও অর্থ বহন করে না। অনেক বাচ্চাই আজকাল এইরকম সমস্যার শিকার। এটি আসলে ‘ভারচুয়াল অটিজম’ অসুখ।
সারা বিশ্বে করা সব গবেষণায় দেখা যায় অল্প বয়সে শিশুদের হাতে ফোন তুলে দিলে তাদের মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু তাই নয়, একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল, গ্যাজেট এবং বেশি টিভি দেখার নেশা শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে। তাই বাড়ছে ভারচুয়াল অটিজমে (Virtual Autism) আক্রান্তের সংখ্যা।
ভার্চুয়াল অটিজম :
অটিজম এক ধরনের নিউরো ডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার। যেখানে শিশুর সামাজিক ও ভাব আদান-প্রদানের ক্ষমতা (Social Communication) কম থাকে ও ব্যবহারে একগুঁয়েমি বা (Stereotypic Behavior) ও ইন্দ্রিয়গত সমস্যা (Sensory Issues) বেশি থাকে। এর কোন নির্দিষ্ট কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে জিনগত ও পরিবেশগত এক বা একাধিক কারণের মিলিত প্রভাবে এই সমস্যা দেখা যায়।
ভার্চুয়াল অটিজমের লক্ষণগুলি সাধারণত চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়। এটি প্রায়শই মোবাইল ফোন, টিভি এবং কম্পিউটারের মতো ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের প্রতি তাদের আসক্তির কারণে হয়। স্মার্টফোনের অধিক ব্যবহার, ল্যাপটপ ও টিভিতে বেশি সময় ব্যয় করার কারণে শিশুরা সমাজ অন্যান্য মানুষের সঙ্গে কথা বলতে এবং যোগাযোগ করতে অসুবিধা অনুভব করতে শুরু করে।
ভারচুয়াল অটিজমে সমস্যাগুলি অনেকটা অটিজমের মতোই হয়, যেমন :
- ছটফটে ভাব
- চোখে চোখে না তাকানো
- অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেশার ক্ষমতা কম
- কথাও কম বলা
কিন্তু ভারচুয়াল অটিজমের ক্ষেত্রে খুব ছোট বয়সে (যেমন দু-বছরের নিচে) প্রচুর পরিমাণে মোবাইল দেখার একটা ইতিহাস পাওয়া যায়। খুব অভিজ্ঞ চোখে অনেক সময় সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরা পড়ে। যেমন সামাজিক সচেতনতাবোধ (social awareness) তুলনায় ভাল হয় ভারচুয়াল অটিজমে আক্রান্তদের।
অটিজম আর ভারচুয়াল অটিজমের পার্থক্য কী?
আসলে শিশুর মধ্যে সামাজিকবোধের আদান-প্রদানের ক্ষমতা কারও কম, কারও বেশি থাকে। যে বাচ্চাদের অটিজম আছে তাদের মধ্যে এই ক্ষমতা খুব কম থাকে। তাই চারপাশের পরিবেশগত উদ্দীপনা একটা স্বাভাবিক মানের মধ্যে থাকলেও বাচ্চাদের মধ্যে তার বহিঃপ্রকাশটা অনেক কম হয়। কিন্তু ভারচুয়াল অটিজমে আক্রান্তদের মধ্যে সামাজিকবোধের আদান-প্রদানের ক্ষমতা একটু হলেও বেশি। কিন্তু চারপাশের পরিবেশগত উদ্দীপনা এদের ক্ষেত্রে খুব বিচ্যুত (Deviant) হয়। তাই এদের মধ্যেও অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
ভারচুয়াল অটিজম নিয়ে এখনও অনেক গবেষণা দরকার। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, যদি দ্রুত মোবাইল বা টিভি দেখা বন্ধ করা যায় ও শিশুকে স্বাভাবিক জাগতিক আদান-প্রদানের মধ্যে ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকটা উন্নতি হয়। অনেক সময় স্বাভাবিকও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটাও ঠিক এই বয়সটা শিশুর বোধ-বুদ্ধি তৈরি হওয়ার বয়স। এই সময় যদি তার যথাযথ বিকাশ না ঘটে এবং সঠিক রাস্তায় আনতে দেরি হয় তাহলে ভবিষ্যতে তার বিকাশের এই বিচ্যুতি যে স্থায়ী হবে না, এমন কথা জোর দিয়ে বলাও একটু মুশকিল।
যদি সন্দেহ হয়, শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত এবং স্ক্রিন এক্সপোজার বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ চিকিৎসা যেমন, অকুপেশনাল থেরাপি ও স্পিচ থেরাপি শুরু করা উচিত। সমস্যা কমে গেলে, থেরাপি বন্ধ যে কোনও সময় করা যেতে পারে, কিন্তু চিকিৎসায় দেরি করা অনুচিত।
তবে সবচেয়ে জরুরি হল রোগের উৎসটি নির্মূল করা। তাই দু’বছর বয়সের কমে একদম মোবাইল ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত নয়। ছ’বছর পর্যন্ত সারা দিনে আধ থেকে এক ঘণ্টা ধীরগতির ভিডিও দেখা যেতে পারে। তবে সবসময় বড়দের পাশে থেকে সেই সব ভিডিওর মানে শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে। ইন্দ্রিয় উত্তেজনা, যা শিশুর কাছে কোনও অর্থ বহন করে না, তার থেকে শিশুদের দূরে রাখাই ভাল।
চারপাশের মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি কথোপকথন খুব দরকার। তবেই সমস্ত ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি সম্ভব। ইন্দ্রিয়গুলি সুসংহতভাবে কাজ করতে পারে। তবেই কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে পারিবারিক, মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক বিকাশে সামঞ্জস্য থাকবে ও শিশুর পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: