মিশর বলতেই মনের অন্দরে উঁকি মারে ধূ ধূ মরভূমির ছবি। বিস্তীর্ণ মরুভূমির মাঝেই গড়ে উঠেছে এক আস্ত দেশ। বড় বড় বিল্ডিং, ঝাঁ-চকচকে রাস্তা। আর মমির দেশ। উঁচু উঁচু পিরামিডের নীচে শায়িত সাদা কাপড়ে জড়ানো মৃতদেহ। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে সব সময়ই রহস্য রয়েছে এই দেশকে ঘিরে। প্রায়ই কোনও না কোনও নতুন কিছু আবিষ্কার হচ্ছে মিশরের মাটিতে। সম্প্রতি মিশরের এক শহর আবার উঠে এল খবরের শিরোনামে।
২০১৯ সাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা দল পড়ে ছিলেন মিশরের আসওয়ান শহরে। নীল নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত এই শহর প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে ‘মৃতের শহর’ বলে পরিচিত।
সম্প্রতি এই শহরে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খুঁজে পেয়েছেন ৩৬টি সমাধি। কোনও সমাধিতে রয়েছে ৩০টি মমি, কোথাও আবার ৪০টি। এ ভাবেই প্রায় ১৪০০টি মমি মাটির নীচ থেকে তুলে এনেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, আসওয়ান শহরটি সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো। বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এসে ভিড় করতেন ওই শহরে। পাহাড়ে চারপাশ ঘিরেই সমাধি দেওয়া হত। মূলত আফ্রিকা এবং ইউরোপের দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসা মানুষেরা এখানে বসতি গড়ে তুলেছিলেন।
বর্তমানে শহরটিকে আসওয়ান বলে ডাকা হলেও অতীতে শহরটি অন্য নামে পরিচিত ছিল। প্রথমে এই শহরটি সুয়েনেট বলে পরিচিত ছিল। পরে নাম পাল্টে হয়ে যায় সওয়ান। যার অর্থ বাজার। পরে সেই নামও পাল্টে হয় আসওয়ান।
আসওয়ান শহরে প্রত্নতাত্ত্বিকদের যে দল খননকার্য চালাচ্ছে তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন মিলান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক প্যাট্রিজিয়া পিয়াসেন্টিনি। তিনি এবং তার সহযোগী পাঁচ বছর ধরে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় খনন চালিয়ে আসছে।
তিনি জানান, আগে পূর্ব থেকে পশ্চিমের দেশে যাওয়ার পথে এই শহরকে আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহার করতেন পর্যটকেরা। একেবারে সীমান্ত এলাকায় শহরটি হওয়ায় সুবিধাও হত মানুষের। ওই শহর থেকেই মানুষ বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তেন।
২০১৯ সালে প্রথম এই শহরটিকে খুঁজে বার করেছিলেন পিয়াসেন্টিনিরা। ওই শহরে প্রথম যে সমাধিটি আবিষ্কার করেছিলেন তারা, সেখান থেকে দু’টি মমি উদ্ধার করা হয়েছিল। প্রথমে অনুমান করা হয়েছিল, সেগুলি মা এবং তাঁর সন্তানের। তবে সিটি স্ক্যানের নয়া রিপোর্টে দাবি করা হচ্ছে, সেগুলি ছিল দু’টি শিশুর। পরে আরও দেহ পাওয়া যায়।
মনে করা হচ্ছে, ওই শহরে যাঁদের সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁরা কোনও না কোনও সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যক্ষ্মা, রক্তের রোগেই বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এই শহরে মানুষকে শ্রেণি অনুসারে সমাধিস্থ করা হত। অভিজাতদের পাহাড়ের চূড়ায় সমাধিস্থ করা হত এবং মধ্যবিত্তদের তাঁদের নীচে সমাধিস্থ করা হত।
এই সমাধিস্থলে প্রায় ১০টি স্তর ছিল। সমাজের উঁচু থেকে নিচু শ্রেণির ভিত্তিতেই স্তরগুলি তৈরি করা হয়েছিল।
পিয়াসেন্টিনির কথায়, সমাধিস্থলটি প্রায় ২ লক্ষ ৭০ হাজার ফুট প্রসারিত। সেখানেই হাজার হাজার বেশি মানুষকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আরও জানান, সমাধিস্থলটি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের মধ্যে ব্যবহার করা হত। প্রতিটি সমাধির মধ্যে অনেক জিনিস মিলেছে, যা থেকে তখনকার মানুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, পারস্য রাজাদের শাসনকাল, গ্রিক টলেমাইক রাজবংশ, রোমান শাসনকাল-সহ ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় সম্পর্কে জানা যাবে এই সমাধিগুলি থেকে।
আগামী দিনেও এই এলাকায় খননকার্য চালাবেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। সেই সঙ্গে শহরটি সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবেন। তাদের মতে, এই আবিষ্কার ইতিহাসের এক নতুন দিক খুলে দেবে।
উদ্ধার হওয়া মমিগুলিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গবেষণাগারে। সেখানেই যাবতীয় পরীক্ষা করা হবে। তার পর বিশ্বের কোনও জাদুঘরে সজ্জিত থাকবে সেগুলি।
সূত্র : আনন্দবাজার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: