সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা একটি জাতির উন্নতির লক্ষণ। তাই সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে জাতির বিচারব্যবস্থা যত উন্নত ও স্বচ্ছ, সে জাতি তত উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। এর মূল লক্ষ্য সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা ঠিক রাখা।
কেউ যেন অন্যায়ভাবে নিপীড়িত না হয়। অপরাধীকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হয়। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ফিরে আসে।
ইসলাম বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ন্যায়ের নীতি অবলম্বন করেছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে মুসলিমরা!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করছেন যে তোমরা আমানত তার হকদারকে আদায় করে দেবে এবং যখন মানুষের মধ্যে বিচার করবে, তখন ইনসাফের সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদের যে বিষয়ে উপদেশ দেন, তা কতই না উত্কৃষ্ট! নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু শোনেন, সব কিছু দেখেন।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
একজন ন্যায়পরায়ণ বিচারকের সঙ্গে মহান আল্লাহর বিশেষ সাহায্য থাকে। ইবনে আবু আওফা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যতক্ষণ জুলুমে লিপ্ত না হবে, ততক্ষণ আল্লাহ তাআলা বিচারকের সঙ্গে থাকেন।
যখন সে জুলুমে লিপ্ত হয়, তখন তিনি তাকে ছেড়ে চলে যান আর শয়তান তাকে চিমটে ধরে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৩৩০)
বাদী থেকে সাক্ষী আর বিবাদী থেকে কসম
বিচারক বাদী থেকে সাক্ষী তালাশ করবেন। সে যদি সাক্ষ্য প্রদান করতে অক্ষম হয়, তখন বিচারক বিবাদী থেকে শপথ নেবেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি শুধু বাদীপক্ষের দাবির ভিত্তিতেই তার পক্ষে রায় প্রদান করা হয়, তাহলে অনেকেই লোকদের জান ও মাল হরণের সুযোগ পাবে। কিন্তু (বাদী সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হলে) বিবাদীর ওপর শপথ করা অনিবার্য হবে।
(যদি বিবাদী শপথ করতে অস্বীকার করে, তবে সে দোষী সাব্যস্ত হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১০৪২ )
বৈধকে অবৈধ করার অধিকার নেই
বিচারকের কথায় কোনো হালাল জিনিস কখনো হারাম হয় না, কিংবা হারাম জিনিস কখনো হালাল হতে পারে না। উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আমার কাছে মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে আসো। আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো প্রতিপক্ষের তুলনায় প্রমাণ (সাক্ষী) পেশ করার ব্যাপারে বেশি বাকপটু। তবে জেনে রেখো, বাকপটুতার কারণে যার অনুকূলে আমি তার ভাইয়ের প্রাপ্য হক ফায়সালা করে দিই, তার জন্য আসলে আমি জাহান্নামের অংশ নির্ধারণ করে দিই। কাজেই সে যেন তা গ্রহণ না করে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৫০১)
তাই কারো বাকপটুতার কারণে কোনো জিনিস যদি তার জন্য ফায়সালা করা হয়, তাহলে এর দ্বারা সে মালিক হয়ে যাবে না; বরং যে এর মালিক সেই তার মালিক। অন্যদের ব্যাপারে ফায়সালা হলেও তা মালিক হবে না।
বাহ্যত সে প্রমাণ উপস্থাপনে বেশি পারদর্শী ও সুদক্ষ হওয়ায় সে নিজ প্রমাণ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে, আর তাতে বোঝা গেছে যে তার দাবিই সঠিক। ফলে তার এই বাহ্যিক প্রমাণ ও বিবরণের ভিত্তিতে আমি রায় দিই, যে সম্পদ নিয়ে বিবাদ হয়েছে তা তারই। কিন্তু সে তো জানে যে বাস্তবিক পক্ষে তার দাবি ভ্রান্ত এবং ওই সম্পদ তার নয়। সুতরাং আমি যতই তার অনুকূলে রায় দিই না কেন, সে যেন কিছুতেই ওই সম্পদ গ্রহণ না করে। কেননা তার জন্য তা হালাল নয়। রায় তার পক্ষে গেলেও প্রকৃতপক্ষে তা তার জন্য জাহান্নামের আগুনস্বরূপ। সে তা ভোগ করলে জাহান্নামের আগুনই ভোগ করা হবে। হারাম মাল ভোগ করা জাহান্নামের আগুন খাওয়ারই নামান্তর।
রাগান্বিত অবস্থায় বিচারকার্য নয়
রাগান্বিত অবস্থায় বিচার না করা, বিচারকের জন্য এটা অতি প্রয়োজন—যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় তাঁর মন ও মস্তিষ্ক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকতে হবে। কেননা তিনি যদি ভারসাম্য পরিত্যাগ করেন, তাহলে অবশ্যই তাঁর মতামত ও ফায়সালা হক ও ন্যায় থেকে দূরে সরে যাবে। ক্রোধের সময় মন ও মেজাজ থেকে ভারসাম্য হারিয়ে যায়। গরমে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং ফায়সালার মধ্যেও কঠোরতা, রূঢ় মেজাজ ও রুক্ষতা সৃষ্টি হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাই এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত দেওয়া নিষিদ্ধ। আবু বাকরা (রা.) বলেন, একদা তিনি তাঁর পুত্রকে লেখেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রাগান্বিত অবস্থায় কাজি যেন কোনো মামলার রায় প্রদান না করেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫৫০)
উপঢৌকন গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা
মিথ্যা সন্দেহ ইত্যাদি থেকে দূরে থাকার নিমিত্তে বিচারকের জন্য কারো থেকে কোনো ধরনের হাদিয়া, উপঢৌকন বা উপহার গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। কারণ এসব হাদিয়া বা উপঢৌকন বিচারকার্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তেমনি সরকারি কর্মচারীদের এমন কারো থেকে হাদিয়া গ্রহণ করা উচিত নয়।
আবু হুমায়দ সাঈদি (রা.) বলেন, নবী (সা.) বনু আসাদ গোত্রের ইবনে লুতবিয়্যা নামের জনৈক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়ের জন্য কর্মচারী বানালেন। সে যখন ফিরে এলো, তখন বলল, এগুলো আপনাদের। আর এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে। এ কথা শোনার পর নবী (সা.) মিম্বারের ওপর দাঁড়ালেন। সুফিয়ান কখনো বলেন, তিনি মিম্বারের ওপর আরোহণ করলেন এবং আল্লাহর হামদ ও সানা বর্ণনা করলেন। এরপর বলেন, কর্মকর্তার কী হলো! আমি তাকে (জাকাত আদায়ের জন্য) প্রেরণ করি, তারপর সে ফিরে এসে বলল, এগুলো আপনার, আর এগুলো আমার। সে তার বাপের বাড়ি কিংবা মায়ের বাড়িতে বসে থেকে দেখত যে তাকে হাদিয়া দেওয়া হয় কি না? যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ! যা কিছুই সে (অবৈধভাবে) গ্রহণ করবে, কিয়ামতের দিন তা কাঁধে বহন করে নিয়ে উপস্থিত হবে। যদি উট হয়, তাহলে তা চিৎকার করবে, যদি গাভি হয় তাহলে তা হাম্বা হাম্বা করবে, অথবা যদি বকরি হয় তাহলে তা ভ্যা ভ্যা করবে। তারপর তিনি উভয় হাত ওঠালেন। এমনকি আমরা তার উভয় বগলের শুভ্র ঔজ্জ্বল্য দেখতে পেলাম। তারপর বললেন, শোনো! আমি কি আল্লাহর কথা পৌঁছে দিয়েছি? এ কথাটি তিনি তিনবার বলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৬৮৬)
লেখকঃ জাওয়াদ তাহের
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: