ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে রোজা পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমরা। তবে এবারের রমজানে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডের চিত্রটা একটু ভিন্ন। ব্যাপক ইসরায়েলি হামলার মধ্যেই ফিলিস্তিনিরা রমজানের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রমজান ঘিরে গাজায় যুদ্ধবিরতির একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এবং এ নিয়ে মিসরের রাজধানী কায়রোয় আলোচনারও আয়োজন করা হয়েছিল। তবে সে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। ফলে রমজানেও থামছে না ইসরায়েলি বর্বরতা।
এদিকে রমজান উপলক্ষ্যে জেরুজালেমের ওল্ড সিটির রাস্তায় হাজার হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যেখানে ইসলামের অন্যতম পবিত্র স্থান আল আকসা মসজিদ অবস্থিত। এই মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রতিদিন কয়েক হাজার উপাসক জড় হয়।
এলাকাটি মুসলিমদের পাশাপাশি ইহুদিদের কাছেও পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত। ইহুদিরা এটিকে ‘টেম্পল মাউন্ট’ নামে চেনে।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভির বলেছিলেন, তিনি আল আকসায় মুসল্লিদের ওপর বিধিনিষেধ চান এবং প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, এর সংখ্যা গত বছরের মতোই হবে।
তবে আল আকসার তত্ত্বাবধানকারী ধর্মীয় ফাউন্ডেশন জেরুজালেম ওয়াকফের মহাপরিচালক আজ্জাম আল-খতিব বলেছেন, ‘এটি আমাদের মসজিদ এবং আমাদের অবশ্যই এর যত্ন নিতে হবে। আমাদের অবশ্যই এই মসজিদে মুসলমানদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিরাপদে বিপুল সংখ্যক মুসল্লি মসজিদে প্রবেশ করতে সক্ষম। ২০২১ সালে ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে আক-আকসা ঘিরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাঁধে। সেই ১০ দিনের যুদ্ধের ভয়াবহতা যদিও গাজায় চলমান ৬ মাস যুদ্ধের কাছে কিছুই না।
গত বছর রমজানে মসজিদ প্রাঙ্গণে পুলিশ প্রবেশ করার সময় সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ওই ঘটনায় আরব লিগের পাশাপাশি সৌদি আরবও নিন্দা জানায়।
গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করে গাজায় প্রায় ছয় মাস ধরে চলছে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১০ মার্চ, রবিবার জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় উপত্যকাটিতে নিহতের সংখ্যা ৩১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহত হয়েছেন ৭২ হাজারের বেশি মানুষ। এ ছাড়া গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নিরলস অভিযান দুর্ভিক্ষের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মধ্যে ফেলে দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের। রমজানের আগমুহূর্তে ক্ষুধায় বিপর্যস্ত গাজাবাসী।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে উপত্যকাটিতে অনাহারে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ বলছে, উত্তর গাজার অবস্থা মর্মান্তিক। সেখানে সড়কপথে ত্রাণ সরবরাহ করা হচ্ছে না। এর ওপর খাবার ও পানির তীব্র সংকটে দুর্ভিক্ষের মুখে রয়েছে ফিলিস্তিনিরা, এ ছাড়া শিশুরা ভুগছে অপুষ্টিতে।
রমজান চলে আসায় ভয়াবহ এই পরিস্থিতির মধ্যেই পবিত্র রমজানকে বরণ করার চেষ্টা করছে ফিলিস্তিনিরা। খোলা আকাশের নিচে থাকা ছেঁড়া তাঁবু সাজিয়েছে সেখানকার শিশুরা। গাজার আশ্রয় শিবিরগুলো মেতে উঠছে বাজি পোড়ানোর উৎসবে। এ ছাড়া বানানো হচ্ছে কাগজের ফুল, শুভেচ্ছা কার্ড। মৃত্যুর ভয়ে থাকা মানুষগুলো এভাবে বরণ করে নিচ্ছে পবিত্র রমজান মাস।
সোয়াদ আজফর নামে বাস্তুচ্যুত এক কিশোরী বলেন, ‘আগে আমরা বাজি পুড়িয়ে রমজানকে স্বাগত জানাতাম, কিছুই এখন নেই।’ সোয়াদের মা আত্তাফ আজফর রমজান উপলক্ষে মলিন তাঁবুতে হালকা আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন, “শিশুদের খুশি রাখতে যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলিয়ে রাখতেই এই আয়োজন।” মধ্যবয়সী এই নারী বলেন, “রমজান মাসের জন্য আমরা সারাবছর অপেক্ষা করতাম। কিন্তু এবার কীভাবে তাঁবুর ভেতর রোজা কাটবে জানি না। খাবার নেই, পানি নেই, তীব্র গরম, কখনো বৃষ্টি বা কখনো শীত। এমন রমজান আমাদের জীবনে এর আগে আসেনি।”
রাফাহ থেকে আসা ওম মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা আমাদের তাঁবুর বাইরে লণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখব।’ শিশুরা উদযাপনের জন্য একটা উপলক্ষ খুঁজে পাওয়ায় খুশি মোহাম্মদ। নেদাল আবুলেনিন নামে গাজার আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতেও ফিলিস্তিনি শিশুরা রমজানকে সামনে রেখে তাদের অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করছে। তারা খেলছে এবং আনন্দের উপলক্ষ তৈরির চেষ্টা করছে।’
এদিকে রমজানের আগে গাজাবাসীর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে একটি বার্তা দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, “রমজান শান্তি, সহনশীলতা ও উদারতার মূল্যবোধকে তুলে ধরে। গাজায় যারা ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন, তাদের সবার প্রতি সংহতি ও সমর্থন জানাচ্ছি আমি। এ কঠিন সময়ে রমজান আমাদের আশার আলো দেখাবে।”
ফিলিস্তিনে রমজানের চাঁদ দেখা গেছে। সৌদি ও আরও কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে সোমবার (১১ মার্চ) থেকে রোজা শুরু হচ্ছে দেশটিতে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মতে, চলমান সংঘাতের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এক হাজারের বেশি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। রমজানে এ দুর্দশার মধ্যেই নামাজ চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
সূত্র: রয়টার্স, আলজাজিরা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: