মাটির নিচে হীরার খনি, তবু খাবার পায় না আফ্রিকার মানুষ

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৫ জানুয়ারী ২০২৪ ১৫:০২

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি

আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটি। তার একদিকে আটলান্টিক মহাসাগর, একদিকে ভারত মহাসাগর এবং একদিকে কুমেরু বা দক্ষিণ মহাসাগর। ক্রিকেটের মাঠে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও, অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় জর্জরিত দক্ষিণ আফ্রিকা। দারিদ্র্য, বৈষম্য, অশিক্ষা এবং অব্যবস্থা দেশটিকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সাথে ভারতের মিল রয়েছে। এই দেশটিকেও দীর্ঘ সময় বিদেশী শক্তির উপনিবেশ হিসেবে কাটাতে হয়েছে। ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফ্রিকাকে মুক্তি দেয় বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।

তবে শুধু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক পীড়ন নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপন্নতার মূলে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি পাথর- হিরে। এই পাথরের খনি দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৮৬৬-৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম হীরা আবিষ্কার হয়। এই আবিষ্কারের পর দক্ষিণ আফ্রিকার কপাল খুলে যাবে বলে মনে করেছে অনেকে। কিন্তু তা হয়নি। বাস্তবে এই হীরাই দেশটির সর্বনাশ ডেকে এনেছে।

প্রথমে ডাচ, তারপর ব্রিটিশ- দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটি পর পর দু’বার ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছিল। তবে প্রথম দিকে উপনিবেশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার তেমন গুরুত্ব ছিল না। হীরা ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

হীরা আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার মাঝে ইউরোপিয় বণিকদের বিশ্রামের জায়গা ছিল। হীরা খুঁজে পাওয়ার পর রাতারাতি দেশটি শিল্পক্ষেত্রে পরিণত হয়। একে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিজ বিপ্লবও বলা হয়ে থাকে।

দক্ষিণ আফ্রিকার হীরাতে সেখানকার সাধারণ মানুষ, আদি বাসিন্দাদের কোনো অধিকার ছিল না। বিদেশীরাই হীরার খনি কাজে লাগিয়ে শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলে। কারখানায় ব্যবহার করা হয় স্থানীয়দের শ্রম। তবে তারা তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেত না।

একাধিক বিদেশী সংস্থা দক্ষিণ আফ্রিকার হীরা শিল্পের দখল নিয়ে ফেলেছিল। তারা নামমাত্র পারিশ্রমিকে স্থানীয়দের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। এভাবে একসময় বিশ্বের ৯০ শতাংশ হীরার জোগানদার হয়ে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা।

যত দিন গেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার আদিবাসীদের ওপর বিদেশী শক্তির অত্যাচার বেড়েছে। হীরা পাচারের সন্দেহে শ্রমিকদের উলঙ্গ করে তল্লাশি চালানো থেকে শুরু করে বেধড়ক মারধর- বাদ ছিল না কিছুই। এই সময় থেকেই সাদা এবং কালো চামড়ার বিভেদ, বৈষম্য গাঢ় হয়ে ওঠে আফ্রিকার ওই দেশটিতে।

সময়ের সাথে সাথে কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্য দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজে ক্ষত আরো গভীর করেছে। বিদ্রোহ, লড়াই, আন্দোলন এবং যুদ্ধের পর ১৯১০ সালে অবশেষে ‘ইউনিয়ন অফ সাউথ আফ্রিকা’র তকমা পায় দেশটি।

এর কয়েক বছর পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি আইন পাশ হয়, যাতে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়, কৃষ্ণাঙ্গেরা ওই দেশে কোনো সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে না। সমাজকে গায়ের রঙের ভিত্তিতে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়- কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত।

কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গের বিভেদ দক্ষিণ আফ্রিকাকে অন্দর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। দেশটির অর্থনীতির মাজা ভেঙে দিয়েছে। আর সব কিছুরই সূত্রপাত হয়েছিল হীরাকে কেন্দ্র করে।

বিপুল হীরার ভাণ্ডারের মালিক হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষ কখনো ওই ভান্ডারের সুবিধা ভোগ করতে পারেননি। তারা চিরকাল বিদেশী শাসনের নিচে ছিল।

১৯৯৪ সালে বিদেশী শক্তিকে সরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্ষমতায় আসে আফ্রিকান ন্যাশানাল কংগ্রেস (এএনসি)। এরপর সমাজে সাম্য ফিরবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু চিত্র বদলায়নি।

বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় বেকারত্বের হার ৩৫ শতাংশেরও বেশি। দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ কর্মহীন। অপরাধমূলক কাজ সেখানে এতটাই বেশি যে প্রশাসনের ওপর ভরসা করে থাকা যায় না। ঘরে ঘরে চুরি-ডাকাতি ঠেকাতে কাঁটাতারের জাল বিছিয়ে রাখতে হয়।

বিদ্যুতের অপ্রতুলতা দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বড় সমস্যা। প্রতি বাড়িতে দিনে অন্তত ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গ্রামীণ এলাকায় পরিস্থিতি আরো খারাপ। দেশটিতে বিদ্যুতের চাহিদা বেশি কিন্তু জোগান কম।

এ সকল সমস্যার সমাধানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি নানা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করে। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা দেশটিকে শোষণ করে চলেছেন আজও।

হিরের দেশ হয়েও তার ঔজ্জ্বল্য নেই দক্ষিণ আফ্রিকায়। ঔপনিবেশিক শাসন, বিদেশী ঔদ্ধত্য, বর্ণবৈষম্যের বিষ ঠেলে কখনো আলোয় মাথা তুলতেই পারেনি দেশটি। তাই অনেকে বলেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্তমান অবস্থার নেপথ্যে দায়ী তারই সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হীরা।


সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: