হাজারো লড়াই-সংগ্রাম ও চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মজলুম মসজিদের নাম ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’। কালের পরিক্রমায় হযরত দাউদ (আ.) ও তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আ.) দ্বয়ের হাত ধরে ব্যাপক সংস্কার মূলক কাজের সংযোজনের মাধ্যমে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এই মসজিদ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই মসজিদ মুসলমানদের হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান করে নেয় বিশেষভাবে। শত-শত নবী-রাসূল, সাহাবী ও অসংখ্য বীর- মুজাহিদদের স্মৃতি বিজড়িত ও ফজিলতপূর্ণ এই মসজিদের শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য নিয়ে কোরআন- সুন্নাহর আলোকে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা তুলে ধরা হলো।
যেভাবে বায়তুল মুকাদ্দাস কিবলা হয়েছিল : নবী (সা.) মক্কা মুকাররমায় থাকাকালীন সময়ে বাইতুল্লাহর দিকে ফিরে নামাজ আদায় করতেন, কিন্তু যখন আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনা মনোয়ারায় হিজরত করলেন, তখন আল্লাহ তাআলা বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিলেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পূর্বে তুমি যে কিবলার অনুসারী ছিলে, আমি তা অন্য কোন কারণে নয়; বরং কেবল এ কারণে স্থির করেছিলাম যে, আমি দেখতে চাই-কে রাসূলের আদেশ মানে, আর কে তার পিছন দিকে ফিরে যায়, সন্দেহ নেই এ বিষয়টা বড় কঠিন, তবে আল্লাহ যাদেরকে হেদায়েত দিয়েছেন, তাদের পক্ষে মোটেই কঠিন না।’ (সূরা বাকারা : ১১৩)। নতুন এই কিবলা গ্রহণ করে নেওয়া যদিও কঠিন ছিল, কিন্তু ঈমানের বলে বলিয়ানরা বিনা বাক্যে তা মেনে নিয়েছিলেন, ওই নির্দেশ মোতাবেক প্রায় সতের মাস বায়তুল মুকাদ্দাস এর দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করলেন। বাইতুল্লাহ যেহেতু বাইতুল মুকাদ্দাস অপেক্ষা বেশি প্রাচীন, উপরন্ত তার সাথে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের স্মৃতি বিজড়িত ছিল, তাই নবী (সা.) তার মনের আকাঙ্ক্ষা ছিল যেন বাইতুল্লাহকেই কিবলা বানানো হয়, বাস্তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যে হয়েছিলও তাই।
কুরআনে বাইতুল মুকাদ্দাস: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ঐতিহাসিক মেরাজ ও মুজেযাপূর্ন ইমামতির অনন্য সাক্ষী বাইতুল মুকাদ্দাস। যার শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য কম-বেশি সবাই জানে, সিরাত ও হাদিসের কিতাব সমূহে বাইতুল মুকাদ্দাসের নানা ফজিলতের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুর শ্রোতা এবং সবকিছুর জ্ঞাতা।’ (সূরা বনী ইসরাইল : ১)।
বাইতুল মুকাদ্দাসে রাসুলের আগমন ও ইমামতি: হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম রাতের বেলা নবী (সা.) এর কাছে আসলেন এবং তাঁকে একটি জন্তুর পিঠে সওয়ার করালেন। জন্তুটির নাম ছিল বুরাক (বুরাক গাধা হতে বড় এবং খচ্চর হতে ছোট একটি সাদা বর্ণের জীব সদৃশ)। বিদ্যুৎগতিতে তাঁকে মসজিদুল হারাম থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে নিয়ে গেল। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আনাস বিন মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার জন্য বুরাক প্রেরণ করা হলো, যতদূর পর্যন্ত তোমার দৃষ্টি যায়, এক পদক্ষেপে সে ততদূর এগিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি এতে সওয়ার হলাম এবং বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত এসে গেলাম। অতঃপর অন্যান্য নবীগণ তাদের বাহন গুলি যে রশি দিয়ে বাঁধছেন, আমি আমার বাহনটিও সে রশি দিয়ে বেঁধে মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামায আদায় করে বের হলাম।’ (মুসলিম : ৩০৮)।
বাইতুল মুকাদ্দাসে নামাজের সওয়াব: পৃথিবীতে অনেক মসজিদ আছে, তবে যেই মসজিদের সম্বন্ধ রাসুলের সাথে হয়, তার সম্মান এমনিতেই বহু গুণে বেড়ে যায়, সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) এই মসজিদে নামাজের ফজিলতের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মসজিদে হারামে এক রাকাত নামাজ এক লাখ রাকাতের নামাজের সমান, আমার মসজিদে (মসজিদে নববী) এক নামাজ এক হাজার নামাজের সমান এবং বাইতুল মুকদ্দাসে এক নামাজ ৫০০ নামাজের সমান।’ (ইলাউস সুনান৫/১৮১)।
বাইতুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ: বাইতুল মুকাদ্দাসের আজমত প্রতিটা মুসলমানের হৃদয়ের মনিকুঠায়, তাই এই মসজিদে নামাজ আদায় ও বরকত লাভের উদ্দেশে ভ্রমণ করা প্রতিটা মুমিনেরই দিলের তামান্না। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন মসজিদ ব্যতীত অন্য কোন মসজিদের দিকে ভ্রমণ করা যাবে না। মসজিদুল হারাম, আমার এই মসজিদ (মসজিদে নববী) এবং মসজিদুল আকসা।’
সুতরাং প্রতিটি মুমিন-মুসলিমের কর্তব্য, ফিলিস্তিন ও এর অধিবাসীদের প্রতি ভালোবাসা রাখা। বাইতুল মুকাদ্দাস ও তার পবিত্রতা রক্ষার চেষ্টা করা। সম্ভব না হলে যেকোনো উপায়ে তাদের সাহায্য করা। তাও সম্ভব না হলে অন্তরে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা ও সেখানকার মুসলিমদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা। এটাই ইমানের দাবি।
লেখকঃ মুফতি আইয়ুব নাদীম
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: