ফিলিস্তিনি প্রতীক হিসেবে তরমুজ ব্যবহারের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস

তরমুজ যেভাবে ফিলিস্তিনের প্রতীক হয়ে উঠল

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:১৫

 ফিলিস্তিনের প্রতীক তরমুজ : সংগৃহীত ছবি ফিলিস্তিনের প্রতীক তরমুজ : সংগৃহীত ছবি

আমেরিকান কবি অ্যারাসেলিস গিরমে তার "ওড টু দ্য ওয়াটারমেলন" কবিতায় লিখেছিলেন, "ফিলিস্তিনে যেখানে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়ানো অপরাধ, সেখানে ফিলিস্তিনের লাল, কালো, সাদা, সবুজ রঙ প্রদর্শনে ইসরায়েলি সৈন্যদের বিরুদ্ধে অর্ধেক কাটা তরমুজ তুলে ধরা হয়।"

গাজায় ইসরায়েলের সর্বশেষ আগ্রাসনের মধ্যে ফিলিস্তিনিপন্থী মিছিলে এবং অগণিত সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে অর্ধেক কাটা তরমুজ প্রতীকটি বিশ্ব জুড়ে ব্যবহার করতে দেখা যায়।

তবে ফিলিস্তিনি প্রতীক হিসেবে তরমুজ ব্যবহারের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পরে, ইসরায়েল যখন গাজা এবং পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, তখন তারা দখলকৃত অঞ্চলগুলোয় ফিলিস্তিনি পতাকা এবং এর রঙের সাথে সাদৃশ্য আছে এমন প্রতীক বহন নিষিদ্ধ করে।

পতাকা বহন করা সেখানে একটি ফৌজদারি অপরাধে পরিণত হয়, ফিলিস্তিনিরা এ কারণে প্রতিবাদ স্বরূপ তরমুজের টুকরো ব্যবহার করতে শুরু করে।

১৯৯৩ সালে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে কয়েকটি ধারাবাহিক অন্তর্বর্তী শান্তি চুক্তি সআ হয় যা অসলো চুক্তি নামে পরিচিত।

লাল, কালো, সাদা এবং সবুজ রঙের পতাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পতাকা হিসেবে স্বীকৃত ছিল, যা গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ পরিচালনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।

অসলো চুক্তি সইয়েরে পরিপ্রেক্ষিতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জন কিফনার তার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, একবার গাজা উপত্যকায় কাটা তরমুজ বহন করার জন্য কয়েকজন তরুণরক গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কারণ, এভাবে ফিলিস্তিনি পতাকার লাল, কালো এবং সবুজ রঙগুলো প্রদর্শন করা হয়েছিল। ইসরায়েলি সৈন্যরা একসময় মিছিলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকত এবং মিছিলে কেউ এ সময়কার এই নিষিদ্ধ পতাকা ওড়ালেই তা কেড়ে নেওয়া হতো।

তারপর থেকে, শিল্পীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে তরমুজের বৈশিষ্ট্যযুক্ত বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরি করতে থাকেন। এরমধ্যে খালেদ হুরানির শিল্পকর্মটি সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পকর্মগুলোর একটি। ২০০৭ সালে তিনি “সাবজেক্টিভ অ্যাটলাস অব প্যালেস্টাইন” শিরোনামে একটি বইয়ের জন্য তরমুজের টুকরোর ছবি এঁকেছিলেন।

দ্য স্টোরি অব দ্য ওয়াটারমেলন নামে অভিহিত পেইন্টিংটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করে। এবং ২০২১ সালের মে মাসে ইসরাইল-হামাস সংঘর্ষের সময় থেকে এই ছবিটি আরও পরিচিত হয়ে ওঠে।

এই বছরের শুরুতে তরমুজের চিত্রায়নে আরেকটি আরেকটি জোয়ার দেখা দেয়। জানুয়ারিতে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন গভির পুলিশকে পাবলিক স্পেস বা জনবহুল স্থল থেকে ফিলিস্তিনি পতাকা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

সেই সময় তিনি বলেন, “এই পতাকা ওড়ানো মানে সন্ত্রাসবাদের সমর্থন করার মতো কাজ।” তখন ইসরায়েল বিরোধী মিছিলে তরমুজের ছবি ব্যবহার হতে দেখা গিয়েছিল।

যদিও ইসরায়েলি আইন ফিলিস্তিনি পতাকাকে বেআইনি ঘোষণা করেনি। তবে পুলিশ এবং সৈন্যদের অধিকার দেওয়া হয়েছে, কোনো ক্ষেত্রে তারা যদি মনে করে এটি জনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি, তাহলে তারা ওই পতাকা সরিয়ে ফেলতে পারবে।

গত জুলাই মাসে জেরুসালেমে এক বিক্ষোভে ইসরায়েল বিরোধী বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনি পতাকার রঙে একটি তরমুজ ধরে প্রতিবাদ যার ওপর লেখা ছিল “স্বাধীনতা” শব্দটি।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিচারিক সংস্কার পরিকল্পনার প্রতিবাদে আগস্টে তেল আবিবে বহু মানুষ বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে জড়ো হওয়ার সময় বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী তরমুজের ছবিযুক্ত টি-শার্ট পরেছিলেন।

অতি সম্প্রতি, গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টেও তরমুজ এবং এর ছবি ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

সম্প্রতি ব্রিটিশ মুসলিম কৌতুক অভিনেতা শুমিরুন নেসা টিকটকে তরমুজের ফিল্টার তৈরি করেন এবং তার ফলোয়ারদের উৎসাহিত করেন তারা যেন তাদের ভিডিও তৈরি করতে এই ফিল্টারটি ব্যবহার করে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন এ থেকে যে আয় হবে তার সমস্ত অর্থ গাজাকে সাহায্যকারী দাতব্য সংস্থাকে দেওয়া হবে।

ফিলিস্তিনির পতাকা ব্যবহার করলে তাদের অ্যাকাউন্ট বা ভিডিওগুলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেটওয়ার্ক থেকে রিচ কমিয়ে দেওয়া হতে পারে, এমন আশঙ্কা থেকেও অনেক ব্যবহারকারী ফিলিস্তিনি পতাকার পরিবর্তে তরমুজ পোস্ট করছেন

এর আগে ফিলিস্তিনপন্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা অতীতে ইনস্টাগ্রামের বিরুদ্ধে "শ্যাডো ব্যানিং" এর অভিযোগ এনেছিলেন।

শ্যাডো ব্যানিং হলো, যখন কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইট বা অনলাইন ফোরাম তাদের একজন ব্যবহারকারীকে তার অজান্তেই ব্লক করে দেয়। এর ফলে সাধারণত তাদের পোস্ট এবং মন্তব্যগুলো অন্য ব্যবহারকারীদের কাছে আর দৃশ্যমান হয় না। এক কথায় ওই প্ল্যাটফর্মটি নিশ্চিত করে যে ওই ব্যবহারকারীর নির্দিষ্ট কিছু পোস্ট অন্যদের ফিডে প্রদর্শিত হবে না।

ফিলিস্তিনে গত কয়েক দশক ধরে তরমুজ একটি রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, বিশেষ করে প্রথম এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ) উভয় ক্ষেত্রেই।

তরমুজ এখন শুধুমাত্র ওই ভূখণ্ডের অসম্ভব জনপ্রিয় খাবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং ফিলিস্তিনি প্রজন্মের জন্য এবং তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের সমর্থনকারীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

সূত্র: বিবিসি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: