আলঝেইমার্সের চিকিৎসায় নতুন যে ওষুধ জাগাচ্ছে আশার আলো

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২০ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩৩

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি


মস্তিষ্কের কোষের মৃত্যুজনিত রোগ আলঝেইমার্সের চিকিৎসায় সাফল্য পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে ডোনানেমাব নামের নতুন এক ধরণের ওষুধ। বিভিন্ন দেশে পরীক্ষা চালানোর পর দেখা গেছে, এই ওষুধ চিন্তা করার শক্তি হারানোর প্রক্রিয়াকে কমিয়ে দেয়। আলঝেইমার্স হচ্ছে মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ এবং ডিমেনশিয়ার একটি সাধারণ রূপ। একে বলে প্রগ্রেসিভ নিউরোলজিক ডিজিজ, যে রোগে মস্তিষ্কের কোষগুলো ধীরে ধীরে মরে যায়।

অ্যান্টিবডি মেডিসিন বা দেহে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা এই ওষুধটি ডিমেনশিয়ার এই ধরনটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া এক ধরনের প্রোটিনকে সরিয়ে দেয়। ফলে এটি প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত রোগীর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করে। খবর বিবিসি।

যদিও এটা কোন প্রতিষেধক নয়, তবে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে যে, জামা নামে চিকিৎসা জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণার ফল আলঝেইমার্স চিকিৎসায় নতুন যুগের সূত্রপাতকে নির্দেশ করছে।

যুক্তরাজ্যের ওষুধ বিষয়ক ওয়াচডগ সংস্থা এটি মূল্যায়ন করে দেখছে যে, এটিকে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বা এনএইচএস এ ব্যবহার করা যায় কিনা। এই ওষুধটি শুধু আলঝেইমার্সের ক্ষেত্রেই কাজ করে, ডিমেনশিয়ার অন্য কোন ধরণ যেমন ভাস্কুলার ডিমেনশিয়ায় এটি কার্যকর নয়।

পরীক্ষায় এই ওষুধটি রোগের গতি এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেয় বলে মনে করা হচ্ছে। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তি তার দৈনন্দিন কাজ, যেমন খাবার তৈরি করা বা কোন শখ উপভোগ করার মতো সুযোগ বেশি পাচ্ছে।

বৈশ্বিক এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যের এমন কয়েক ডজন মানুষের মধ্যে মাইক কলি একজন, তার বয়স ৮০ বছর। তিনি এবং তার পরিবার বিশেষভাবে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন।

লন্ডনের একটি ক্লিনিকে প্রতিমাসে একবার এই ওষুধ ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করে থাকেন। এই পরীক্ষা শুরু করার কিছু দিন আগে মাইক এবং তার পরিবারের সদস্যরা খেয়াল করেন যে, তিনি তার স্মৃতি মনে করা এবং সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ছেন। তার ছেলে মার্ক বলেন যে, শুরুতে এই বিষয়টা দেখা খুবই কষ্টকর ছিল।

“তথ্য প্রক্রিয়া করতে এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষেত্রে সে যে ধরণের সমস্যার মুখে পড়ছিল তা দেখাটা খুব কষ্টকর ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এখন তার সমস্যাটা এমন একটা পর্যায়ে এসেছে যে, এটি আর খারাপ হচ্ছে না।”

কেন্টের বাসিন্দা মাইক বলেন, “আমি প্রতিদিনই আরো বেশি আত্মবিশ্বাস অনুভব করি।”

ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এলি লিলির তৈরি করা ডোনানেমাব ওষুধটি লিকানেমাব নামে আরেকটি ওষুধের মতোই কাজ করে। লিকানেমাব ওষুধটি তৈরি করেছিল এইসাই এন্ড বায়োজেন নামে ওষুধ কোম্পানি। তাদের ওষুধটি এই রোগের চিকিৎসায় কার্যকর প্রমাণিত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে এটি সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছিল।

অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হলেও এই ওষুধগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়।

ডোনানেমাবের পরীক্ষায় এক তৃতীয়াংশ রোগীর মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল। বেশিরভাগের ক্ষেত্রে অবশ্য কোন ধরণের উপসর্গ প্রকাশিত হওয়ার আগেই এটি প্রতিকার করা সম্ভব হয়েছিল।

তবে দুইজন স্বেচ্ছাসেবী এবং সম্ভবত আরো একজনের মস্তিষ্ক মারাত্মক ফুলে উঠার কারণে পরীক্ষা চলাকালীন মারা গেছেন। আরেকটি অ্যান্টবডি ড্রাগ যার নাম ছিল আদুকানুমাব, সুরক্ষা ইস্যুতে সেটি সম্প্রতি ইউরোপীয় নিয়ন্ত্রকরা বাতিল করে দিয়েছেন। এছাড়া ওই ওষুধটি যে রোগীদের উপর কাজ করছিল তারও কোন প্রমাণ ছিল না।


ডিমেনশিয়া কী এবং এটি হলে কী করবেন?

ডোনানেমাব ওষুধের পরীক্ষার সময় গবেষকরা ৬০ থেকে ৮৫ বছর বয়সী ১৭৩৬ জন মানুষের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যারা আলঝেইমার্সের প্রাথমিক স্তরে ছিল।

এদের অর্ধেককে মাসে একবার করে ধীরে ধীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে এই ওষুধ দেয়া হয়েছে। আর বাকি অর্ধেক মানুষকে ওষুধের মতো একটি তরল দেয়া হয়েছে যা প্ল্যাসেবু নামেও পরিচিত। অর্থাৎ এমন একটি ওষুধ যাতে আসলে কোন সক্রিয় ওষুধি উপাদান নেই যেমন চিনির বড়ি ইত্যাদি। পুরো প্রক্রিয়া চলেছে ১৮ মাস ধরে।

এর থেকে যা পাওয়া গেছে তা হলো:
এই ওষুধটির কিছু সুবিধা রয়েছে, অন্তত কিছু রোগীর ক্ষেত্রে এটি কাজ করেছে। যারা এই রোগটির প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন এবং যাদের মস্তিষ্কে অ্যামিলইড নামে এক ধরণের প্রোটিনের পরিমাণ কম ছিল তাদের উপর এই ওষুধ বেশি কার্যকর ছিল। মস্তিষ্ক স্ক্যান করে সেটি পরিষ্কার দেখা গেছে।

যাদেরকে এই ওষুধ দেয়া হয়েছিল তারা তাদের দৈনন্দিন নানা কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছেন। যেমন সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, ফোনকলের উত্তর দেয়া বা কোন শখ পূরণ করা।
আক্রান্ত ব্যক্তি তার দৈনন্দিন কাজ কতটা চালিয়ে যেতে পারেন তার মাধ্যমে রোগের গতি নির্ণয় করা হয়। সেই গতি এই ওষুধ নেয়ার ফলে সার্বিকভাবে ২০-৩০ শতাংশ ধীর হয়েছে বলে গবেষকরা জানাচ্ছেন। একই সাথে যেসব রোগী এই ওষুধের প্রতি ভাল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে রোগের গতি ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত ধীর হয়েছে বলে ধরা হচ্ছে।

ডোনানেমাব গ্রহণকারী রোগীদের অর্ধেকই এক বছর পর চিকিৎসা নেয়া ছেড়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ ওই ওষুধ তাদের মস্তিষ্ককে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।

আলঝেইমার্স মতো জটিল রোগের ক্ষেত্রে অ্যামিলইড একটি মাত্র অংশ। তাই দীর্ঘ সময়ে এই চিকিৎসা আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখবে কিনা তা নিয়ে সতর্ক রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, এই ওষুধের প্রভাব হয়তো মোটামুটি, কিন্তু এর মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া যায় তাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে মস্তিষ্ক থেকে অ্যামিলইড সরিয়ে ফেলা সম্ভব হলে তা আলঝেইমার্সের গতি পাল্টে দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে এতে আক্রান্ত রোগীরা ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে পুরোপুরি সেরেও উঠতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ডিমেনশিয়া গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক গিলস হারডিংহাম বলেন: “আজ এই ফল পুরোপুরিভাবে প্রকাশিত হয়েছে দেখে দুর্দান্ত লাগছে।” “আইলঝেইমার্সের চিকিৎসার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করেছি, তাই এই খাতে বাস্তব অগ্রগতি ঘটতে দেখাটা আসলেই অনেক উৎসাহব্যঞ্জক।” যুক্তরাজ্যের আলঝেইমার্স রিসার্চ এর গবেষক ডা. সুসান কোলহাস বলেন: “আজকের ঘোষণা আরেকটি মাইলফলক স্পর্শ করলো।”

যুক্তরাজ্যের নিউরোরেডিওলজিস্ট কনসালটেন্ট এবং রিকগনিশন হেলথ এর মেডিক্যাল ডিরেক্টর ডা এমির ম্যাসসুইনি ডোনানেমাব ওষুধের পরীক্ষার নেতৃত্ত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন: “এটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বড় অগ্রগতি গুলোর মধ্যে একটা।” আলঝেইমার্স সোসাইটি বলেছে: “আলঝেইমার্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এটি আসলেই একটি নতুন মোড় এবং বিজ্ঞান প্রমাণ করছে যে এই রোগের গতি ধীর করে দেয়া সম্ভব।”

আলঝেইমার্সের চিকিৎসায় নতুন উদ্ভাবিত এই ওষুধ ব্যবহারের অনুমতি পেলে যুক্তরাজ্যের প্রায় সাত লাখ ২০ হাজার মানুষ উপকার পেতে পারে। কিন্তু আলঝেইমার্স সোসাইটি বলছে যে, এনএইচএস “খুব সাধারণভাবে এটা সরবরাহ করতে প্রস্তুত নয়।”

দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কেইট লি বলেন: “সময় মতো সঠিক চিকিৎসাই চাবিকাঠি, এবং বর্তমানে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মাত্র দুই শতাংশ মানুষ এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা পাচ্ছেন।”

“এর পাশাপাশি, আলঝেইমার্সের এই নতুন উদীয়মান ওষুধগুলো নিয়মিত ইনজেকশনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গ্রহণ এবং পর্যবেক্ষণে থাকার দরকার হয়, আর এনএইচএস এখনই এতো বিশালাকারে এই সেবা দিতে প্রস্তুত নয়।”

 

সূত্র : ‍বিবিসি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: