ফাইল ছবি
                                    নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ইতিহাস গড়তে চলেছেন ডেমোক্রেটিক পার্টি মনোনীত প্রার্থী জোহরান মামদানি। জনমত জরিপগুলোতে তিনি এগিয়ে আছেন। যদি তিনি জেতেন, তবে তিনি হবেন ১০০ বছরের মধ্যে শহরের সর্বকনিষ্ঠ, প্রথম মুসলমান ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র।
কয়েক মাস আগেও মামদানি তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন হিপ হপ শিল্পী ও আবাসন উপদেষ্টা। এখন নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেমব্লিম্যান এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের নেতৃত্বে আসার দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে। গত শনিবার জোহরান মামদানিকে ফোন করে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার প্রশংসা করেছেন।
মামদানির উত্থান ও রাজনীতি
মামদানি বর্তমানে ত্রিমুখী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ভাইরাল ভিডিও এবং পডকাস্টারদের মাধ্যমে তিনি অনেক প্রান্তিক ভোটারের কাছে পৌঁছে গেছেন। এমন একসময়ে তাঁর উত্থান ঘটল, যখন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতি আস্থা তলানিতে।
তবে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করা নিয়ে প্রশ্ন আছে। নির্বাহী অভিজ্ঞতা ছাড়া তিনি কীভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সম্ভাব্য আক্রমণ সামলাবেন, তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
মামদানি নিজেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। এর মূল কথা হলো, করপোরেশনের চেয়ে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দেওয়া। তিনি বার্নি স্যান্ডার্স এবং আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করটেজের মতো বামপন্থি রাজনীতির জাতীয় মুখ হয়ে উঠেছেন।
ট্রাম্প এরই মধ্যে হুমকি দিয়েছেন, নিউইয়র্কবাসী কোনো সমাজতন্ত্রীকে বেছে নিলে ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করা হবে। মামদানির পাল্টা জবাব, তিনি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাজনীতিবিদদের মতো। তবে গায়ের রং একটু তামাটে। নিউইয়র্কবাসী জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সংগ্রাম করছেন। তাই মামদানির জয় গতানুগতিক রাজনীতির প্রতি প্রত্যাখ্যান হিসেবে দেখা হবে। এটিই তাঁর প্রধান নির্বাচনী ইস্যু।
মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ও এজেন্ডা
গত মঙ্গলবারের নির্বাচনে তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন সাবেক ডেমোক্রেটিক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো। প্রাইমারিতে হেরে যাওয়ার পর কুওমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। কুওমোর অভিযোগ, মামদানির ব্যবসায়ীবিরোধী এজেন্ডা নিউইয়র্ককে শেষ করে দেবে। কুওমো নিজেকে ট্রাম্পের মোকাবিলাকারী হিসেবে দাবি করলেও মামদানি তাঁকে প্রেসিডেন্টের পুতুল বলেন। এদিকে রিপাবলিকান মনোনীত প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া তাদের দুজনকেই বিদ্রুপ করেন।
মামদানির নির্বাচনী বার্তা হলো, সাশ্রয়ী জীবনযাপন এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। তাঁর প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলো হলো, সর্বজনীন শিশু দিবাযত্ন, বাসা ভাড়া না বাড়ানো, বিনামূল্যে বাস পরিষেবা এবং সরকারিভাবে মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা। এসব বার্তা আকাশছোঁয়া দামে অতিষ্ঠ নিউইয়র্কবাসীর কাছে জনপ্রিয়।
অর্থায়ন ও অনভিজ্ঞতার প্রশ্ন
মামদানি তাঁর বিশাল এজেন্ডার খরচ মেটাতে করপোরেশন এবং কোটিপতিদের ওপর নতুন কর বসানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, এতে ৯০০ কোটি ডলার রাজস্ব উঠবে। যদিও সমালোচকদের মতে, এই হিসাব সঠিক নয়। নতুন কর আরোপের জন্য তাঁকে গভর্নর ক্যাথি হোচুল এবং রাজ্য আইনসভার সমর্থন পেতে হবে। হোচুল তাঁকে সমর্থন দিলেও বর্ধিত আয়করের বিপক্ষে। তবে তিনি মামদানির ৫০০ কোটি ডলারের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মামদানি বলেন, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে শুধু কর্তৃত্ববাদী প্রশাসনের বিরোধিতা করাই যথেষ্ট নয়, বরং শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব চাহিদাগুলো পূরণ করাও জরুরি।
জুনে মামদানি ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে জেতার পর ওয়াল স্ট্রিটের নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ শহর ছেড়ে যাওয়ার হুমকিও দেন। তবে পরিস্থিতি পাল্টেছে, তারা এখন সহযোগিতা করতে আগ্রহী। জেপি মরগান চেজের সিইও জেমি ডাইমন মামদানি নির্বাচিত হলে তাঁকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন।
যদিও রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার জেফরি গুরাল মনে করেন, মামদানি দেশের বৃহত্তম শহরের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অনভিজ্ঞ। তিনি মনে করেন, তাঁর ট্যাক্স পরিকল্পনা ধনী উচ্চ উপার্জনকারীদের শহর থেকে দূরে সরিয়ে দেবে।
মামদানি অবশ্য সমালোচকদের সঙ্গে দেখা করার জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়েছেন। সম্প্রতি ৪০ ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে তারা তাঁর এজেন্ডা ও ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করেন। ওই বৈঠকে উপস্থিত একজন ব্যবসায়ী জানান, মামদানি সব প্রশ্নের উত্তর খুব ভালোভাবে দিয়েছেন।
অবস্থান পরিবর্তন ও বিতর্ক
জোহরান মামদানি সমালোচনার মুখে তাঁর কিছু অবস্থান পরিবর্তন করেছেন। ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর তিনি পুলিশকে ‘বর্ণবাদী’ বলে তাদের তহবিল কমানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখন তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। জননিরাপত্তা এখন প্রধান ইস্যু। মামদানি বর্তমান পুলিশ কমিশনারকে রাখার পক্ষে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য পুলিশের একটি নতুন কমিউনিটি সেফটি বিভাগ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে, ইসরায়েলের সমালোচনা এবং ফিলিস্তিনি অধিকারের প্রতি তাঁর সমর্থন অপরিবর্তিত। এই অবস্থানটি নিউইয়র্কের ইহুদি জনসংখ্যা অধ্যুষিত শহরে বিভাজন তৈরি করতে পারে। তাঁর সমালোচকরা ইসলামভীতিও ছড়াচ্ছেন। যদিও তাঁর প্রচারে অনেক ইহুদিও অংশ নিচ্ছেন।
পার্টির ভবিষ্যৎ
ডেমোক্রেটিক পার্টির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নিউইয়র্কের বাসিন্দারা উদারপন্থি। মামদানিকে বিজয়ের পথে যা চালিত করতে পারে, তা হয়তো জাতীয় রাজনীতিতে কাজ নাও করতে পারে। দলে মধ্যপন্থি এবং প্রগতিশীলদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটরা তাঁর উত্থানের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত। সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার মামদানিকে সমর্থন করেননি। নিউইয়র্কের প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যালঘু নেতা হাকিম জেফ্রিস প্রাথমিক ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন।
ডেমোক্র্যাট বিশ্লেষকরা বলেছেন, দলের মূল কাঠামোর জন্য মামদানি নতুন সমস্যা তৈরি করছেন। ট্রাম্প এবং রিপাবলিকানরা ইতোমধ্যে ডেমোক্র্যাটদের (যতই মধ্যপন্থি হোক না কেন) সমাজতন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরছেন।
নিউ জার্সির মধ্যপন্থি ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধি জোশ গটহাইমার বলেছেন, মামদানির দৃষ্টিভঙ্গি ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে বেমানান। রিপাবলিকানরা এই প্রার্থীকে জুজু হিসেবে ব্যবহার করবেন।
এ বিষয়ে মামদানি বলেন, বিরোধিতা নিঃসন্দেহে থাকবে। তবে এর চেয়ে বেশি রয়েছে জনসমর্থন।
            
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
                                                        
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: