রাশিয়া থেকে তেল আমদানি নিয়ে ভারতের উপর ট্রাম্পের চাপ তৈরি করছে উত্তেজনা

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:৫৬

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মুখে যা বলেন, কাজেও ঠিক তাই করেন- তেমনটা নয়। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বন্ধু বলে সম্বোধন করে থাকেন। কিন্তু গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ট্রাম্প ভারতকে কোনোভাবেই স্বস্তি দেননি।

চলতি বছরের ২৭ আগস্ট থেকে ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপানো ৫০ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক কার্যকর হয়েছে এবং এর প্রভাবও কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি ২০ শতাংশ কমেছে এবং গত চার মাসে এই পতন ৪০ শতাংশ।

দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ’-এর পরিচালক অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি আরোপের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারত। এই বিশেষজ্ঞের মতে, আগামী মাসগুলোতে রফতানির ক্ষেত্রে এই পতনের পরিমাণ আরো বাড়বে।

এদিকে, হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের সাথে কথোপকথনের সময় বুধবার ট্রাম্পকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘মোদি একজন মহান ব্যক্তি। তিনি ট্রাম্পকে লাইক (পছন্দ) করেন।’

তারপর তাকে হাসতে হাসতে এ-ও বলতে শোনা যায়, ‘আমি চাই না আপনি অন্য কোনোভাবে লাইক শব্দটাকে ব্যবহার করুন। আমি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নষ্ট করতে চাই না।’

একইসাথে প্রেসিডেন্টকে দাবি করতে শোনা যায়, রাশিয়ার কাছ থেকে তেল না কেনার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘আপনারা জানেন এমনটা (তেল কেনা বন্ধ করার প্রসঙ্গে) হঠাৎই করা সম্ভব নয়। এর জন্য একটা প্রক্রিয়া রয়েছে যা শিগগিরই সম্পন্ন হবে।’

ভারতের জন্য সমস্যা

এদিকে ট্রাম্পের এই দাবির পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, মোদির সরকার কি সত্যিই এমন কোনো আশ্বাস দিয়েছে?

ট্রাম্পের এই বক্তব্যে দেশের ভেতরে আক্রমণের মুখে পড়েছে মোদি সরকার। শুধু তাই নয়, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের কোনো নীতিগত পরিবর্তনের ঘোষণা কি এবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করছেন?

ভারতের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী বৃহস্পতিবার এক্স প্লাটফর্মে (সাবেক টুইটার)-এ এক পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পকে ভয় পাচ্ছেন। আমরা ট্রাম্পকে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল না কেনার সিদ্ধান্ত নিতে এবং সে বিষয়ে ঘোষণা করতে দিচ্ছি।’

‘উপেক্ষা করা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দন বার্তা পাঠান। অর্থমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শারম আল-শেখে যাননি এবং অপারেশন সিন্দুর নিয়ে ট্রাম্পের দাবির বিরোধিতা করেননি,’ অভিযোগের সুরে বলেন তিনি।

এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের দাবি সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি।’

এর আগে, রণধীর জয়সওয়াল আরেকটা বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন, ভারত তার ভোক্তাদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এনার্জি ইম্পোর্ট বা জ্বালানি আমদানি সংক্রান্তনীতি তৈরি করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শুক্রবার ট্রাম্পকে আবারো একই দাবি করতে শোনা যায়। তিনি আরো একবার উল্লেখ করেন, ভারত আর রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনবে না।

এদিকে, ভারত কিন্তু সরাসরি বলেনি যে ট্রাম্প ভুল বলছেন। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার কোনো আশ্বাসও ভারত দেয়নি। এ বিষয়ে অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ‘ট্রাম্প এমন এক সময় এই দাবি করছেন যখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কথা চলছে।’

‘স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্র একটা শক্তিশালী দেশ। তাই প্রেসিডেন্ট যদি কিছু বলেন, তাহলে ভারতের মতো দেশকে তার জবাব দিতে গেলে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তবে আমি মনে করি, জবাব দেয়ার বিষয়ে ভারতের এখন একটু স্পষ্টতা রাখা উচিত।’

রাশিয়া কিন্তু ইরান নয়

রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার বিষয়ে ট্রাম্প যা দাবি করেছেন, সেই সংক্রান্ত ভিডিও এক্স-এ রিপোস্ট করে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কানওয়াল সিব্বল বলেন, ‘তাদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে এটাই সমস্যা। ট্রাম্প বিভ্রান্ত করেন। নিজের মতো করে কথার মানে করে নেন।’

প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদেই ট্রাম্প ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার জন্য ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু ইরানকে রাশিয়ার সাথে তুলনা করা যায় না। স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে ঐতিহাসিকভাবেই রাশিয়া ভারতের অংশীদার।

ওয়াশিংটনে অবস্থিত উইলসন সেন্টারের ‘সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট’-এর পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প দাবি করেছেন যে মোদি তাকে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা কঠিন।’

‘ চাপের পর ভারত ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ইরান রাশিয়ার মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয় এবং তখন ভারতের কাছে বিকল্প সরবরাহকারী ছিল, যা এখন আর নেই।’

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ট্রাম্প যেভাবে জনসমক্ষে কথা বলছেন সেটা কিন্তু এই পুরো বিষয়কে আরো জটিল করে তুলছে।

ভারতের বাড়তে থাকা দ্বিধা

আন্তর্জাতিক রাজনীতির একজন নিবিড় পর্যবেক্ষক নিরুপমা সুব্রামানিয়ান পাকিস্তানে ‘হিন্দু’র সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, ট্রাম্প শুধু ভারতকে আঘাত করছেন না, আন্তর্জাতিকভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছেন তিনি। তার প্রথম মেয়াদকে মাথায় রেখে এটা অনুমান করা সম্ভব হয়নি যে তিনি এতটা যেতে পারেন।’

গত সাত দশক ধরে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক মজবুত ও স্থিতিশীল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করও বলেছিলেন যে গত ৫০ বছরের বৈশ্বিক রাজনীতিতে দুই দেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল রয়েছে।

কোল্ড ওয়ারের সময়, ভারত নিজেকে জোট নিরপেক্ষ বলে অভিহিত করত। তবে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছিল। গত তিন দশকে রাশিয়ার সাথে মহাকাশ, পরমাণু শক্তি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতা বেড়েছে।

এদিকে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ভারতের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। এর ফলে প্রতিরক্ষা বিষয়ে রাশিয়ার ওপর ভারতের নির্ভরতা কমতে থাকে।

প্রসঙ্গত, গত অর্থবর্ষে (যা চলতি বছরের ৩১ মার্চ শেষ হয়েছে) ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য রেকর্ড ৬৮.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। স্পষ্টতই, ভারত আরো বেশি আমদানি করেছে। মোট ৬৮.৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের মধ্যে ভারতের মাত্র ৪.৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রফতানি করেছে।

ভারতে রাশিয়ার বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে তেল, গ্যাস, ফার্মা, ব্যাংকিং, রেলওয়ে ও ইস্পাত। রাশিয়ায় তেল, গ্যাস ও ওষুধ শিল্পেও ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল পায়। তবে দামের পার্থক্য প্রতিনিয়ত কমছে।

ব্লুমবার্গ-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত, ভারত রাশিয়া থেকে বেঞ্চমার্ক ক্রুডের চেয়ে প্রতি ব্যারেলে আড়াই ডলার কমে তেল পাচ্ছিল। তবে ২০২৩ সালে এই পার্থক্য ব্যারেল প্রতি ২৩ ডলারেরও বেশি ছিল।

কার পক্ষে থাকলে উপকার হবে?

ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আইসিআরএ তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের মার্চ মাসে শেষ হওয়া গত আর্থিকবর্ষে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ওপর ছাড় হ্রাসের কারণে, তেল কেনার ক্ষেত্রে ভারত মাত্র ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করেছে।

অন্যদিকে, রফতানির দিক থেকে ভারতের কাছে রফতানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ৮৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিক্রি করেছে।

নিরুপমা সুব্রামানিয়ান জানান, ভারতের জন্য বিষয়টা মোটেই সহজ নয়। মোদি যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা অব্যাহত রাখেন তাহলে তা সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি করবে। আর তিনি যদি ওই তেল কেনা বন্ধ করে দেন, তাহলে রাশিয়ার সাথে যে পুরনো বন্ধুত্ব রয়েছে, তার ওপর থেকে আস্থা কমে যাবে।

ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্স-এর তথ্য বলছে, ট্রাম্পের নির্ধারিত শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি ৫২ শতাংশ হ্রাস হতে পারে এবং তা মাঝারি মেয়াদে ভারতের জিডিপি ০.৮ শতাংশ হ্রাস করতে পারে।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড হিসাব অনুযায়ী, ভারত যদি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দেয় তবে বার্ষিক আমদানি বিল চার বিলিয়ন ডলার থেকে ৬.৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যেতে পারে।

অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, এই অর্থবছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভারত রাশিয়া থেকে ১৯.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল আমদানি করেছে। গত বছরের এই একই সময়ে, ভারত রাশিয়া থেকে ২২.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল আমদানি করেছিল। অর্থাৎ, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি গত বছরের তুলনায় ইতোমধ্যে ১১.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

অন্যদিকে গত বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতের তেল আমদানি দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছিল, তবে এই বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সময়ে তা বেড়ে পাঁচ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৭৮.৬ শতাংশ বেড়েছে।

অর্থাৎ ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল আমদানি বাড়িয়েছে এবং রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ কমেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ট্রাম্প খুশি নন এবং এটাই ভারতকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: