
বুধবার পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়ন করলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এই প্রথম একজন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের কোনো সেনাপ্রধানকে আতিথ্য দিলেন, যিনি দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান নন। আসিম মুনির পাঁচ দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।
অথচ সাত বছর আগে ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, এই দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘মিথ্যা আর প্রতারণা ছাড়া কিছুই দেয়নি’ এবং এটি সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচ্য । আর তাঁর পূর্বসূরি জো বাইডেন এই দেশটিকে ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। সেই দেশের প্রতি ট্রাম্পের এই মনোভাব একটি নাটকীয় পরিবর্তন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রশাসনের অধীনে সম্পর্ক পুনর্গঠনের কাজটি কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলছিল। গত মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বল্প সময়ের কিন্তু তীব্র সামরিক সংঘাতের সময় এটি আরও সুসংহত হয়। ওই সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছিল।
অবশ্য কিছু বিশ্লেষক সতর্ক করে বলছেন, নতুন করে গড়ে ওঠা এই সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক নীতির পরিবর্তে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অবস্থানের ফল হিসেবে দেখা উচিত। মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের (এমইআই) জ্যেষ্ঠ ফেলো মারভিন ওয়েইনবাউম বলেন, ‘আমরা এমন একটি প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছি, যারা প্রতি ঘণ্টায় তাদের সুর পাল্টায়। এখানে নিয়মনীতি বলে কিছু নেই।’
মারভিন আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই বলছে তো পরের মিনিটেই অগ্রাধিকার দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে। আপনি এমন একটি প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছেন, যেটি অস্থির এবং ব্যক্তি-নিয়ন্ত্রিত। এটি প্রথাগত পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’ তবে অন্যরা বলছেন, আসিম মুনিরকে ট্রাম্পের আতিথ্য জানানোর এই দৃষ্টিভঙ্গির তাৎপর্য রয়েছে।
সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ডিস্টিংগুইশড লেকচারার রাজা আহমদ রুমি বলেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে ট্রাম্পের মধ্যাহ্নভোজের আমন্ত্রণ কেবল প্রোটোকল (রাষ্ট্রীয় রীতিনীতি) ভঙ্গই নয়, এটি প্রোটোকলকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। তিনি আরও বলেন, এটি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়, পাকিস্তান শুধু ওয়াশিংটনের নজরেই নেই, বরং দেশটি ঘনিষ্ঠ মহলের মধ্যেই রয়েছে; অন্তত এই সময়ে।
ট্রাম্প ও আসিম মুনিরের বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে। ১৩ জুন থেকে ইরানের শহরগুলোতে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। ইরানও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে জবাব দিয়েছে।
ইরানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, পারমাণবিক স্থাপনা এবং বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ২০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গত ছয় দিনে ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় ২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় সরাসরি যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েলের সরকার। ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। আসিম মুনিরের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের পর ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প উল্লেখ করেন, পাকিস্তানিরা ‘ইরানকে খুব ভালো চেনে, বেশির ভাগ মানুষের চেয়ে ভালো’। তবে তিনি আরও বলেন, তারা (পাকিস্তানিরা) ‘খুশি নন’।
ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, আসিম মুনিরের সঙ্গে এই সাক্ষাতের প্রধান কারণ ছিল মে মাসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার সংঘাত নিরসনে তাঁর ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানানো। এই সংঘাতটি ১৬০ কোটির বেশি মানুষের বাসস্থান এই অঞ্চলকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্কের জন্য পরিচিত ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘তাঁকে (আসিম মুনির) এখানে আমন্ত্রণ জানানোর কারণ ছিল আমি তাঁকে (ভারতের সঙ্গে) যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছি। আমি প্রধানমন্ত্রী মোদিকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমরা ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কাজ করছি।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরও বলেন, ‘এই দুই অত্যন্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তি এমন একটি যুদ্ধ চালিয়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেটি পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারত। পাকিস্তান ও ভারত দুটি বড় পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।’ আসিম মুনিরকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আজ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি।’
এই সংকট শুরু হয়েছিল গত এপ্রিলে ভারতশাসিত কাশ্মীরে একটি হামলার পর। ওই হামলায় ২৬ জন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। ভারত এ জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছিল। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য, স্বাধীন, স্বচ্ছ’ তদন্তের আহ্বান জানায়।
গত ৭ মে পাকিস্তানের ভূখণ্ড ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তান তাদের বিমানবাহিনীর মাধ্যমে হামলার জবাব দেয়। দেশটি দাবি করে, তারা অন্তত ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ভারত ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করলেও নির্দিষ্ট সংখ্যা জানায়নি।
এই সংঘাত আরও তীব্র হয় যখন উভয় পক্ষ তিন দিন ধরে ড্রোন হামলা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত ১০ মে সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। নেপথ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যুক্ত হওয়ায় সংঘাতের অবসান ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বুধবার তাঁর ভূমিকার কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছি। এই ব্যক্তি (আসিম মুনির) পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এটি থামাতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকায় ছিলেন, মোদি ভারতের পক্ষ থেকে; অন্যরাও ছিলেন।’
পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার কথা স্বীকার করলেও ভারত জোর দিয়ে বলে আসছে, কেবল দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
ওয়াশিংটনভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা পলিট্যাক্ট-এর চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট আরিফ আনসার বলেন, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা ট্রাম্পকে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগে আগ্রহী করে তুলেছে।
আরিফ আনসার বলেন, ‘দেশটি (পাকিস্তান) প্রমাণ করেছে, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তারা অনেক বড় প্রতিপক্ষকে কৌশলে পরাস্ত করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে মূল কৌশলগত স্বার্থ মাথায় রেখে পাকিস্তানের প্রথাগত ক্ষমতা কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত হতে উৎসাহিত করেছে।’
আরিফ আনসার আরও বলেন, বৈশ্বিক ক্ষমতার পালাবদলের এই সময়ে পাকিস্তান আবারও একটি বড় কৌশলগত বিকল্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বলেন, অনেক কিছু নির্ভর করছে দেশটি চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকছে তার ওপর। এই সিদ্ধান্তটি ক্রমবর্ধমান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং ইরানের ভূমিকার সঙ্গেও জড়িত।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা ওয়েইনবাউম এই সম্পর্ককে অস্থায়ী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, ট্রাম্পের ‘এই প্রশাসনে কিছুই স্থায়ী নয়’। তিনি বলেন, ‘যদি ইরান সংকটে পাকিস্তান কিছু ভূমিকা পালন করে, তাহলে এই সম্পর্কের আরও উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য থাকতে পারে। তবে এই প্রস্তুতি থাকতে হবে যে এই প্রশাসনের সঙ্গে কিছুই স্থির নয়। এটি যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো সময়ে পরিবর্তন হতে পারে।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: