আর মাত্র ৫ দিন পরই নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে ঐতিহ্যগতভাবে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠান প্রতি চার বছর পর ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। নতুন প্রশাসনে নিজের পছন্দমতো মন্ত্রীসভাও ইতোমধ্যে সাজিয়ে ফেলেছেন তিনি।
তবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শেষদিককার সময়টা খুব একটা যে সুখনীয় হয়নি এবং তিনি তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার গড়তে যে একপ্রকার ব্যর্থই হয়েছেন তা ওঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির একটি প্রতিবেদনে। দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তার রাজনৈতিক সাফল্য থেকে শুরু করে ব্যর্থতার আদিগন্ত।
এর আগে যেসব প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচনের মাধ্যমে আমেরিকার জনগণের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, তা বাইডেনের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। গ্যালাপের একটি জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে মাত্র ৩৯% মানুষ তার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। যা তার মেয়াদের শুরুতে ছিল ৫৭%। তার জনপ্রিয়তা যে তার শাসনামলের সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে তা গ্যালাপের জরিপই বলে দিচ্ছে। এমন বিষণ্ন সমাপ্তি বিশ্ব সচরাচর দেখা যায়নি বিদায়ী প্রেসিডেন্টদের বেলায়।
ক্ষমতার একদম শেষদিকে এসে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমি চাই ইতিহাস বলুক আমি এসেছিলাম অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও বিশ্বে আমেরিকার নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। আমি সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এটি করেছি।
যদিও জো বাইডেন তার প্রেসিডেন্সির শেষ পর্যায়ে এসে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। বাইডেন এবং তার প্রশাসনকে এমন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে, যার কিছু ছিল তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তবে এমন অনেক ঘটনা, যা চাইলেই তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন কিংবা এড়িয়ে যেতে পারতেন; সেসব ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তের কারণে চড়ামূল্য দিতে হয়েছে প্রশাসনকে ।
২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের সময় যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, সেটাকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রথম বড় ভুল পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ফলে তার জনপ্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং তার নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
সেবছর আগস্ট মাস শেষ হওয়ার আগেই, বাইডেনের গ্যালাপ রেটিং ৫০%-এর নিচে নেমে যায়।
দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও বাইডেনের শুরুর সময়টি সুখকর ছিল না। ২০২১ সালের গ্রীষ্মে মুদ্রাস্ফীতি ৫%-এর সীমা অতিক্রম করে ৯.১%-এ পৌঁছায়। যা গত ৩০ বছরে প্রথমবারের মতো ঘটেছিল। যদিও ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে মুদ্রাস্ফীতি ৩%-এর নিচে নেমে আসে, বেকারত্বের হার কমেছিল, অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল, তারপরও দেশটির ভোটাররা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন।
এদিকে কোভিড-পরবর্তী মার্কিন-মেক্সিকো সীমান্তে অভিবাসীদের অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি সামলাতে ব্যাপক হিমশিমও খাচ্ছিলেন বাইডেন। এর ফলে সমালোচনার মুখেও পড়েন তিনি। সেখানকার অভিবাসীদের উত্তরাঞ্চলীয় শহরে স্থানান্তরের ঘটনা প্রশাসনকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ফেলে দেয়। এর পাশাপাশি কোভিড পরীক্ষার কিট ও শিশুখাদ্যের ঘাটতি, ডিমের উচ্চমূল্য, গর্ভপাত অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত রায়ের অবসান এবং ইউক্রেন ও গাজার যুদ্ধের মতো ঘটনা নতুন নতুন সমস্যায় ফেলে।
ইসরাইলের প্রতি বাইডেনের সমর্থন দেশটির মাঝে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিতর্ক সৃষ্টি করে। এতে তার জনপ্রিয়তা আরও কমে যায়। আর ন্যাটো ইস্যুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে একপ্রকার বাইডেনের সিদ্ধান্তেরই ফসল সেটিতো প্রায় ওপেন সিক্রেট।
বাইডেনের আরেকটি দুর্বলতা ধরা হয় তার পড়তি বয়সকে। এক সময় তিনি দক্ষ বক্তা ও নানা সমস্যার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পরিচিত থাকলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত জনসাধারণের কাছে তাকে ডুবন্ত নৌকার মতোই অর্থহীন করে তোলে।
বিশেষ কাউন্সিল রবার্ট হার একটি প্রতিবেদনে তাকে দুর্বল স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেন, যা ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
এছাড়াও মিডিয়ার সঙ্গে বাইডেনের যোগাযোগ ক্রমশ কমে আসে। তার ভুল ও অসাবধান নানা মন্তব্য রিপাবলিকানদের কাছে আক্রমণের অস্ত্র হয়ে ওঠে। শুরুর দিকে প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য কিছু আইন পাস করলেও পরবর্তী সময়ে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও জনসাধারণের কাছে না পৌঁছাতে পারার কারণে বাইডেন প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে।
তবে এতসব ব্যর্থতার মাঝে তার যে সাফল্য ছিল না তা নয়। তিনি তার প্রশাসনে অনেক অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যুক্ত করেছিলেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ছিলেন সিনেটে তার পররাষ্ট্রনীতি উপদেষ্টাদের একজন। ট্রেজারি সেক্রেটারি ছিলেন জ্যানেট ইয়েলেন। যিনি আগে ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান ছিলেন।
তিনি স্বাস্থ্যসেবা ভর্তুকি বৃদ্ধি, কোভিড ভ্যাকসিন বিতরণের জন্য অর্থায়ন এবং শিশু দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসিতও হয়েছেন সবার কাছে।
তবে এই সাফল্য চ্ছেদ পড়ে তার ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে কর এবং অস্ত্র-সংক্রান্ত মামলার বিষয়টিতে। এটি বাইডেনের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ছেলে হান্টারকে মাফ করার সিদ্ধান্তও ব্যাপক সমালোচিত হয় সেসময়।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে বাইডেন তার পুনর্নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তবে তার রাজনৈতিক প্রচারণা ও শারীরিক দুর্বলতা সেসময় সমালোচিত হয়। অন্যদিকে ট্রাম্পকে এগিয়ে নিতে থাকলে তার পরিবর্তে তিনি তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য মনোনীত করেন। তবে নারী নেতৃত্বে দেশটির মানুষ খুব একটা ভরসা করতে না পারায় হিলারী ক্লিনটনের মতো কমালাকেও পরাজয় বরণ করতে হয়, যা বাইডেন প্রশাসনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা বলে বিবেচনা করা হয়।
বাইডেন যদি ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা না দিয়ে দলকে নতুন নেতৃত্বের সুযোগ দিতেন, তাহলে হয়ত তার উত্তরাধিকার ও সাফল্য নিশ্চিত হতো।
এদিকে নতুন মেয়াদে বন্ধু ইলন মাস্ককে মূল হাতিয়ার করে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। ট্রাম্পের দাবি তিনি বাইডেনের অর্জনগুলোকে ভেঙে ফেলে আমেরিকাকে আবার মহান করার চেষ্টা করবেন। তবে সে যাত্রায় কতটুকু সফল হবেন ট্রাম্প তা হয়ত গ্যালাপের নতুন কোনও জরিপই বলে দেবে।
আর জো বাইডেনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কীভাবে প্রস্তুত হবে আরেকটি নতুন নির্বাচনে জয়ের জন্য তা ট্রাম্পের অর্জন ও নতুন প্রশাসনের কার্যকলাপই বলে দেবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: