লেবাননে ইসরায়েলের অভিযানের বিস্তার এবং স্থল আক্রমণ ও বোমাবর্ষণ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকান প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। তারা আলোচনা করছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বাড়তি আমেরিকান সামরিক উপস্থিতি কি এই সংঘাতকে সীমিত করছে, নাকি আরও উত্তেজনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।
হামাসের আক্রমণের এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনি-ইসরায়েল সংঘাতে ইয়েমেন, ইরান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশ জড়িয়ে পড়েছে। পেন্টাগন অঞ্চলটিতে ব্যাপক পরিমাণ অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিমানবাহী রণতরী, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, অ্যাম্ফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ ও ফাইটার স্কোয়াড্রন।
এই সপ্তাহে পেন্টাগন ঘোষণা করেছে যে, তারা আরও কয়েক হাজার সেনা মোতায়েন করবে এবং যুদ্ধবিমানের উপস্থিতি দ্বিগুণ করবে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এই অস্ত্রশস্ত্র ও অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়েছে ইসরায়েলকে রক্ষা করতে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ঘাঁটিতে অবস্থানরত আমেরিকান সেনাদের সুরক্ষা দিতে।
পেন্টাগনের ডেপুটি মুখপাত্র সাবরিনা সিং বৃহস্পতিবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রতিরক্ষা বিভাগের নেতৃত্ব নাগরিক এবং সেনাদের সুরক্ষা, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা এবং প্রতিরোধ ও কূটনীতির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার দিকে মনোযোগী।
তিনি আরও বলেন, আমেরিকান সেনাদের বাড়তি উপস্থিতি আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের ঝুঁকি কমাতে মোতায়েন করা হয়েছে।
তবে, কয়েকজন পেন্টাগন কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, ইসরায়েল ক্রমশ হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে একটি আক্রমণাত্মক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। হিজবুল্লাহ ইরানপন্থি সবচেয়ে শক্তিশালী মিলিশিয়া বাহিনী।
তাদের ধারণা, ইসরায়েল এই অভিযান পরিচালনা করছে কারণ তারা জানে যে, একটি বিশাল নৌবহর এবং ডজনখানেক যুদ্ধবিমান ইরানের যেকোনও পাল্টা আঘাত মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে।
গত বছর পর্যন্ত পেন্টাগনের মধ্যপ্রাচ্য নীতির শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডানা স্ট্রুল বলেছেন, বর্তমানে অঞ্চলটিতে যথেষ্ট সামরিক প্রস্তুতি রয়েছে, তাই ইরান যদি আক্রমণ করে, আমরা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সহায়তা করতে পারব।
হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আক্রমণাত্মক অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, আপনি যদি ইসরায়েল হন এবং একজন সামরিক পরিকল্পনকারী হন, তবে আপনি এই ধরনের অভিযান পরিচালনা করবেন তখন যখন অঞ্চলটিতে পর্যাপ্ত সামরিক উপস্থিতি আছে।
আমেরিকান সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল চার্লস কিউ ব্রাউন জুনিয়র পেন্টাগন ও হোয়াইট হাউজে এই প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এই বাড়তি আমেরিকান সামরিক উপস্থিতি সামগ্রিক যুদ্ধ প্রস্তুতির ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলছে—বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের ক্ষেত্রে।
জেনারেল ব্রাউন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনসহ অপর কর্মকর্তারা সংঘাত সীমিত করার এবং ইসরায়েলকে সহযোগিতা করার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন। একজন ঊর্ধ্বতন আমেরিকান সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েল যদি জানে যে তার পাশে ‘বড় ভাই’ রয়েছে, তাহলে তাদের জন্য আক্রমণে যাওয়া সহজ হয়ে যায়।
কয়েকজন কর্মকর্তা আরও বলেছেন, ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করা পেন্টাগনের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ ইসরায়েল এখন স্পষ্ট করে বলেছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আগেভাগে কোনও আক্রমণের বিষয়ে সতর্ক করবে না।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা ইসরায়েলিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং ধারণা করেছিলেন যে ইসরায়েল সীমিত স্থল অভিযানে যাবে। কিন্তু ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাগুলো বড় আকার ধারণ করেছে। গত সপ্তাহে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট পেন্টাগনকে না জানিয়ে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন। পেন্টাগনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এই ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় তারা পাননি।
ডেপুটি মুখপাত্র সাবরিনা সিং এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, অস্টিন ‘অপ্রস্তুত’ ছিলেন এবং এটি ছিল উভয় পক্ষের জন্য একটি দৃঢ় আলোচনা।
এরপর পেন্টাগন ঘোষণা করে, তারা আরও কয়েক হাজার আমেরিকান সেনা মোতায়েন করবে। এর মধ্যে দুই থেকে তিন হাজার সেনা ও তিন স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান ও প্রযুক্তিবিদ থাকবেন।
ইরান সরাসরি আমেরিকান সেনাদের ওপর আক্রমণ করেনি। তবে তাদের সমর্থিত মিলিশিয়ারা এমন হামলা করে আসছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জর্ডানে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের আক্রমণে তিনজন আমেরিকান সেনা নিহত এবং ৪০ জন আহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হামলা চালায়।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল মাইকেল ই. কুরিলা অতিরিক্ত আমেরিকান সেনা মোতায়েনের অনুরোধ করেছিলেন। ইরানের সম্ভাব্য পাল্টা আঘাতের সময় আমেরিকান সেনাদের রক্ষা করতে এবং ইসরায়েলকে সহায়তা নিশ্চিত করতে এই অনুরোধ করা হয়েছিল।
গত মঙ্গলবার ইরানের পাল্টা আঘাতের সময় নৌবাহিনীর দুটি ডেস্ট্রয়ার একসঙ্গে এক ডজন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে। তবে, ইসরায়েল তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মূল প্রতিরক্ষা পরিচালনা করেছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাতকে সীমিত করার চেষ্টা করেছে বাইডেন প্রশাসন। তবে, পেন্টাগনের কর্মকর্তারা এখন চিন্তিত যে, এই সংঘাতের ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে আমেরিকান সামরিক মনোযোগ সরে যেতে পারে। এই অঞ্চলে চীনের সামরিক আগ্রাসন এবং তাইওয়ান নিয়ে যে উত্তেজনা রয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে আমেরিকান সামরিক মনোযোগ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
জেনারেল ব্রাউন বলেন, বিশ্বের এক অংশে যা ঘটে তা অন্য অংশকেও প্রভাবিত করে। আমাদের অবশ্যই সেই সংযোগগুলো তৈরি রাখতে হবে, যাতে আমরা এক এলাকা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে অন্য কোথাও অপ্রস্তুত না হয়ে যাই।
মধ্যপ্রাচ্যে থেকে প্রায় এক দশক ধরে আমেরিকান সেনাদের প্রত্যাহারের চেষ্টা সত্ত্বেও অঞ্চলটিতে আবারও আমেরিকান সামরিক শক্তির ব্যাপক উপস্থিতি ঘটছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি অ্যাম্ফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ এবং তিনটি গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার রয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: