সভ্যতার উন্নয়নে মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবদান অপরিসীম। মুসলিম বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মুসলিমরা সমকালীন বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়লেও তারা রিক্তহস্ত নয়; বরং সমকালে বহুল ব্যবহৃত অনেক কিছুই মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়- মেডিসিন, সার্জারি, হাসপাতাল তৈরিতে একসময় মুসলিম বিজ্ঞানীরা পৃথিবীজুড়ে অগ্রগামী ছিল।
ইতিহাসবিদ আল কিফতি তার ‘তারিখুল হুকামাত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হজরত ইদ্রিস আলাইহিস সালাম হলেন প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। আর ইসলামের সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসাবিজ্ঞানী’।
ইতিহাসের পাতায় আরো পাওয়া যায়- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জীবদ্দশায় (বিভিন্ন যুদ্ধকালীন সময়ে) ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। মসজিদে নববীর আঙিনায়ও রোগীরদের চিকিৎসা এবং সেবার ব্যবস্থা ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবিদের মধ্যেও কেউ কেউ চিকিৎসাব্যবস্থা জানতেন। এ বিষয়ে হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু, হজরত হারিস বিন কালদা রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও ইসলামের ইতিহাসে একজন নারী সাহাবি মদিনায় প্রথম স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মহীয়সী এই নারী সাহাবির নাম ছিল ‘রুফাইদা আল আসলামিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা’। যুদ্ধ ছাড়াও এই মহীয়সী নারীর তাবু ছিল অসুস্থদের আস্থার ঠিকানা। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তিনি কোনোরূপ বিনিময় গ্রহণ ছাড়াই রুগীদের সেবা দিয়েছেন। জিহাদের কঠিন মুহূর্ত ছাড়াও রোগীর সেবা-শুশ্রূষায় এমন আরো অনেক নারী সাহাবির নাম পাওয়া যায়; যাদের নাম আজ-ও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
মূলতঃ রোগীর সেবা-শুশ্রূষা একটি মহান ইবাদত। এর মাধ্যমে পরস্পরের মাঝে ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। পারিবারিক ও সামাজিক সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধন গভীর হয়। মহাগ্রন্থ কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা থেকে মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অনুপ্রেরণা পেয়েই চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তারা অবদান রাখেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন মুসলিম মনীষীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো-
ইবনে সিনা :
তিনি ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বুখারায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০৩৭ খৃস্টাব্দে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পবিত্র কোরআনের হাফেজ ছিলেন। তার পুরো নাম ছিল আবু আলী হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। তাকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। ধারণা করা হয় যে তিনি ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাসহ মোট ২৪০টি গ্রন্থ বর্তমানে টিকে রয়েছে
আল-রাজী :
তিনি ৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার পুরো নাম ছিল- আবু বকর মোহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া আল রাজী। তিনিই প্রথম হাম এবং গুটি বসন্তকে আলাদা রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর আগে দুটো রোগকে একই ভাবা হতো। তাকে মনোবিজ্ঞান এবং সাইকোথেরাপির জনক হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
ইবনে রুশদ :
তিনি ১৪ এপ্রিল ১১২৬ সালে (৫২০ হিজরি) স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০ ডিসেম্বর ১১৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার পুরো নাম- আবু আল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে রুশদ। চিকিৎসা ছাড়াও তিনি দর্শন, ইসলামি শরিয়াহ, গণিত, আইন, ওষুধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন।
আল জাহরাউয়ি :
তিনিও ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার পুরো নাম- আবু আল কাশিম খালাফ ইবনে আল আব্বাস আল জাহরাউয়ি। ঐতিহাসিকদের মতে তিনিই সর্বপ্রথম ইউরোপে বৈজ্ঞানিক প্রথায় সার্জারির প্রচলন এবং এর বিশদ বিবরণ প্রচার করেন। তাকে মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বের মহৎ শল্যবিদ ও আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক বলে গণ্য করা হয়।
ইবনে নাফিস :
তিনি ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পুরো নাম- আলাউদ্দিন আবুল হাসান আলি ইবনে আবুল হাজম ইবনুন নাফিস আল কোরায়েশি আল দামেস্কি। তিনি মানবদেহে বায়ু ও রক্ত সঞ্চালনের ব্যবস্থা আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।
আহমদ ইবনে তুলুন :
আহমদ ইবনে তুলুনিদ সাম্রাজ্যের একজন শাসক ছিলেন। তিনি মানুষের চিকিৎসা ও সুস্থতার স্বার্থে এই হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পৃথিবীর ইতিহাসে নবম শতকে মিসরে সর্বপ্রথম হাসপাতাল ব্যবস্থার সূচনা হয়। আহমদ ইবনে তুলুন ৮৭২ সালে মিসরের রাজধানী কায়রোতে ‘আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নবম শতকে তিউনিসিয়ায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগের এ সময়ে মুসলমানদের তৈরি সবচেয়ে ভালো বিস্তৃত বিন্যাস ও পরিবেশবান্ধব হাসপাতাল শাসক ওদুদ আল ওয়ালিদ ৯৮২ সালে বাগদাদে নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে হাসপাতাল ব্যবস্থার ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ আধুনিক বিশ্বে চিকিৎসার জন্য এই যে হাসপাতাল ব্যবস্থা সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন মুসলিমরা। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে হাসপাতাল ব্যবস্থা চালু হয়।
চিকিৎসা শাস্ত্র ছাড়াও বিজ্ঞানের আরো বিভিন্ন শাখায় মুসলিমদের অবদান খুঁজে পাওয়া যায়। গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, উদ্ভিদবিদ্যা, জোর্তিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: