প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বিশ্ববাণিজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলপথ মনে করা হয় সিল্করোডকে। চীন থেকে শুরু হয়ে যা মধ্য এশিয়া ছেদ করে ভূমধ্য সাগর পর্যন্ত পৌঁছেছিল। ঐতিহাসিক সিল্করোড শুধু পণ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম ছিল না; বরং এর মাধ্যমে সংযোগ ঘটেছিল বহু জাতি, গোষ্ঠী, সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্মের মধ্যে। পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে যারা নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছিল।
সিল্করোডের সঙ্গে যুক্ত ছিল আধুনিক সময়ের চীন, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, ভারত ও তুরস্ক। এসব অঞ্চলের শহরগুলো হয়ে উঠেছিল বহু মাত্রিক সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র। পারস্পরিক বিনিময়ের কারণে মুদ্রণ, কাচ, কাগজ, ওষুধ, কৃষি ইত্যাদি শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল এসব অঞ্চলে। সমৃদ্ধ হয়েছিল দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য।
সিল্করোডের সঙ্গে যুক্ত চারটি প্রাচীন মুসলিম বাণিজ্যনগরীর পরিচয় তুলে ধরা হলো।
সমরকান্দ : আধুনিক উজবেকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী শহর সমরকান্দ। শহরটি সরাসরি সিল্করোডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। শত শত বছর ধরে সমরকান্দ একটি সুপ্রসিদ্ধ বাণিজ্যনগরী, যা তার কারুশিল্প ও জ্ঞানচর্চার জন্য বিখ্যাত।
ইতিহাসবিদদের দাবি, হান শাসনামল থেকে সমরকান্দের ব্যবসায়ীরা চীনে বাণিজ্য করতে যেত। তারা বিভিন্ন প্রকার ধাতব, মসলা ও কাপড়ের ব্যবসা করত। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে তথা তৈমুরের সময় সমরকান্দ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়। তৈমুর সমরকান্দকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করতে কেন্দ্রীয় মহাসড়ক নির্মাণ করেন। যার দুই পাশে ছিল বহু দোকান ও বিক্রয়কেন্দ্র। তৈমুরের নাতি উলুবেগ ছিলেন বড় মাপের বিজ্ঞানী। তিনি সমরকান্দে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি এখানে একটি মানমন্দিরও নির্মাণ করেন।
আলেপ্প : আধুনিক সিরিয়ার একটি প্রাচীনতম নগরী আলেপ্প। যা ভূমধ্য সাগরের পূর্ব তীর ও ফোরাত নদীর মোহনায় অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে যাত্রা শুরু করা আলেপ্পর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাধিক বাণিজ্যপথ। সিল্করোডের গুরুত্বপূর্ণ শহরও ছিল এটি। হাজার বছর ধরে এটি ভূমধ্য সাগরের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। সিল্করোডের স্বর্ণযুগে তথা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ পর্যন্ত সময়টুকু আলেপ্পর জন্যও ছিল স্বর্ণযুগ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, বহুজাতিক বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে শহরটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
আলেপ্পর স্বর্ণযুগের সাক্ষ্য বহন করছে এর ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাজার। বাজারটিই শহরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। এখনো এ বাজারের একেক অংশ একেক নামে চিহ্নিত করা হয়। যেমন সুতার বাজার, তামার বাজার, কাপড়ের বাজার, মসলার বাজার ইত্যাদি। টিকে আছে মধ্যযুগে গড়ে ওঠা একাধিক সরাইখানা বা আবাসিক হোটেল। যেগুলোতে বিদেশি বণিক ও পর্যটকরা অবস্থান করত।
মসুল : সিল্করোডের সঙ্গে যুক্ত ছিল ইরাকের বাণিজ্যনগরী মসুল। এখনো তা উত্তর ইরাকের প্রধান শিল্প, বাণিজ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর মুসলিম ভূগোলবিদ আল-মাকদিসি মসুল শহরের বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন, ‘মসুল অত্র অঞ্চলের মহানগর। এটি অত্যন্ত সুন্দর ও সুপরিকল্পিত নগরী। এর আবহাওয়া চমৎকার ও পানি স্বাস্থ্যকর। এখানে আছে জনবহুল বাজার ও সরাইখানা। এখানে বহু শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী বসবাস করেন। ডাক্তার ও আইনজ্ঞদের অভাব নেই এখানে। মসুলে উন্নতমানের জীবনোপকরণ পাওয়া যাওয়া।’ মসুলে উৎপাদিত উন্নতমানের মসলিন কাপড় সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
মার্ভ : মধ্য এশিয়ার মরুশহর মার্ভ বর্তমানে তুর্কমেনিস্তানের সীমানাভুক্ত। ইসলামী শাসনামলে মার্ভ ছিল খোরাসান প্রদেশের রাজধানী। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে মার্ভ পৃথিবীর বৃহত্তম নগরীতে পরিণত হয়। আব্বাসীয় আমলে তথা অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মার্ভ ছিল পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রাশাসনিক, শিল্প-বাণিজ্য ও শিক্ষা কেন্দ্র। এ সময় এখানে বহু ধরনের শিল্প ও পেশার বিকাশ ঘটে। যেমন স্থাপত্য-কারিগর, মুদ্রা বিনিময়কারী, স্বর্ণকার, তাঁতি, তামা-ইস্পাত শিল্পী ও কুমার। উন্নতমানের কাপড় ও কাচের তৈজসপত্রের জন্য মার্ভের বিশেষ সুনাম ছিল। এখান থেকে বিশ্বের নানাপ্রান্তে উন্নতমানের রেশম সুতা ও কাপড়, সূক্ষ্ম কারুকাজবিশিষ্ট কাচের আসবাব রপ্তানি হতো।
সূত্র : ইকনা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: