হযরত খাজা আবদুল্লাহ আনসারি (রহ.): মধ্য এশিয়ার এক দরবেশ কবি

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৮ জানুয়ারী ২০২৪ ০৬:২১

প্রতীকী ছবি প্রতীকী ছবি

হযরত খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ: (১০০৬-১০৮৮ খ্রি.) একাদশ শতকের মধ্য এশিয়ার একজন দরবেশ কবি ও বিখ্যাত সাধক-বুজুর্গ। তিনি বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু আইউব আনসারি রা:-এর নবম বংশধর। তার পূর্বপুরুষরা ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে আরব দেশ থেকে খোরাসানে আগমন করেন। আবদুল্লাহ আনসারি রহ: ১০০৬ সালের ৪ মে তৎকালীন ইরানের অধিভুক্ত খোরাসানের হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানটি বর্তমানে পশ্চিম আফগানিস্তানে অবস্থিত। গোটা মধ্য এশিয়ায় তিনি ‘পীর-ই-হেরাত’ নামে সমধিক পরিচিত। তার পূত সংস্পর্শে এসে বহু মানুষ আল্লাহর পথের সন্ধান পায়।

আল্লাহ তায়ালার ইবাদত, সুন্নাতে রাসূল সা:-এর অনুসরণ, দাওয়াত-তাবলিগ, চরিত্র সংশোধন, অধ্যাত্মসাধনা ও মানবসেবার চর্চা করেন এবং অগুনতি মানুষকে শিক্ষা ও দীক্ষা দেন জীবনের ৮২ বছর। তিনি একাধারে মুফাসসির, মুহাদ্দিস, আরবি ও ফার্সি কবি। তার রচিত পবিত্র কুরআনের তাফসির ‘কাশফুল আসরার’ ছিল পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে। মহানবী সা:-এর ৩০ হাজার হাদিস খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুখস্থ ছিল। ইতিহাস খ্যাত সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামি রহ: তাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আরবি ও ফার্সি ভাষায় স্বচ্ছন্দে কবিতা রচনায় খাজা আবদুল্লাহ আনসারি ছিলেন পারদর্শী।

তিনি মোট ১৮টি গ্রন্থ রচনা করেন। ইলাহীনামা, গাঞ্জনামা, কানযুস সালেকিন, মুনাজাতনামা, যাদুল আরিফিন, নাসায়েহ, কলন্দারনামা, রিসালায়ে ওরাদাত, রিসালায়ে দিল ও জান, হাফ্ত হিসার, রিসালায়ে মানাকিবে আহমদ ইবন হাম্বল, আনোয়ারুত তাহকিক, কিতাব আল-ফারুক, মানাযিলু সাঈরিন ও জামিউল কালাম তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী এ সাধক পুরুষের কবিতা হেরাতের গভর্র্নর হাউজের দেয়ালে উৎকীর্ণ ছিল।

হিমালয়ান উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী রহ: হেরাতে অবস্থানকালে খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মাজারসংলগ্ন মসজিদে রাত কাটাতেন আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে (মাওলানা আবদুল মালেক, শাখছিয়াতে আফগানিস্তান কী রূহ পরওর ইয়াদেঁ, পৃ: ২৬৬-২৭৬)। কোর নলেজ ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম হতে ২০০৪ সালে তাঁর ‘নসিহত ও মুনাজাত’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তার চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি, প্রার্থনার প্রকরণ ও প্রকর্ষ মানবজাতির সম্পদ।

বর্ণিত আছে, প্রায় এক লাখ ফার্সি কবিতা তার কণ্ঠস্থ ছিল। তিনি নিজে ৬০০০ পঙক্তি কবিতা রচনা করেন। আল্লাহর পরিচয়, মানুষের সাথে আল্লাহর স¤পর্ক, সৎচিন্তা, সৎকর্ম, পাপ পরিহার, পরোপকার, হিতসাধন, মানবসেবা, তাওবা, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও সুন্নাতে রাসূলের পুনরুজ্জীবন হলো তার রচনার মূল প্রতিপাদ্য। আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর ‘মুনাজাত’ এর অনুবাদ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। অত্যন্ত নামকরা ব্যক্তিবর্গ এর অনুবাদক ও পাঠক। ফার্সিতে রচিত তার একটি দার্শনিক কবিতার ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ নিম্নে প্রদত্ত হলো-

I Came
By Khwaja Abdullah Ansari
From the un-manifest I came,
And pitched my tent, in the Forest of Material existence.
I passed through mineral and vegetable kingdoms,
Then my mental equipment carried me into the animal kingdom;
Having reached there I crossed beyond it;
Then in the crystal clear shell of human heart
I nursed the drop of self in a Pearl,
And in association with good men
Wandered round the Prayer House,
And having experienced that, crossed beyond it;
Then I took the road that leads to Him,
And became a slave at His gate;
Then the duality disappeared
And I became absorbed in Him.
(Translated by Sardar Sir Jogendra Singh, The Persian Mystics : Ansari (The Wisdom of the East Series), London, 1951)

‘আমি এসেছিলাম’
অপার্থিবতার নিগূঢ় থেকে এসে,
আমি তাঁবু গেড়েছিলাম পার্থিবতার অরণ্যে,
আমি অতিক্রান্ত করেছি খনিজ ও উদ্ভিজ্জ সাম্রাজ্য,
তারপর মনন আমায় বয়ে নিয়েছিলো প্রাণিজগতে,
পৌঁছে সেথায়, পেরিয়ে গেলাম তা,
এরপর মানব হৃদয়ের স্ফটিক-স্বচ্ছ খোলসে নিজেকে বিকশিত করলাম মুক্তোয়,
আর সৎ সংসর্গে পরিভ্রমণ করলাম প্রার্থনাগৃহ,
অভিজ্ঞতার আস্বাদন শেষে পেরিয়ে গেলাম সেটিও,
তারপর বেছে নিলাম তাঁকে পাওয়ার পথ
আর তাঁর দরোজায় অনুগত দাসে পরিণত হলাম,
অতঃপর অন্তর্হিত হলো সত্তার দ্বৈধতা
আর আমি বিলীন হলাম তাঁরই মাঝে।


ভারতের জাতীয় নেতা গান্ধী আনসারির মুনাজাত ও নসিহত ইংরেজিতে অনুবাদ বের হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। সরদার স্যার যোগেন্দ্র সিংহ আনসারির মুনাজাত ও নসিহত ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং The Wisdom of the East Series গ্রন্থমালায় ১৯৫১ সালে তা লন্ডনে মুদ্রিত হয়। যোগেন্দ্র সিংহ আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত এর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন : ‘শান্তির মন্দিরে শিষ্যত্ব গ্রহণের পথে এ মুনাজাত সঠিক পথনির্দেশনা। অন্তর হতে উত্থিত এ মুনাজাত তার অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। তার অন্তর যা চেয়েছে, তা তিনি পেয়েছেন। অন্যদের নিকট যা গুপ্ত ও লুকানো, তা প্রত্যক্ষ করেছেন আনসারি। তার আবিষ্কার প্রমাণ করে, সত্য অপরিবর্তনীয়। সব যুগের সত্যপ্রাপ্ত সাধকেরা একই সুরে কথা বলেছেন। ইন্দ্রিয়াচ্ছন্ন চেতনায় আনসারির উক্তির মর্ম অগম্য। লালসার ঝড় হতে উত্থিত কুজ্ঝটিকা ভেদ করতে পারে আত্মিক সাধনা’ (Sardar Sir Jogendra Singh, The Persian Mystics : Ansari (The Wisdom of the East Series), London, 1951, pp.1-10)।

মরহুম প্রিন্সিপ্যাল রেজাউল করিম চৌধুরী বিখ্যাত সাধক-বুজুর্গ খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত বাংলায় ভাষান্তর করেন। এই ঐতিহাসিক গ্রন্থের ভূমিকায় বিজ্ঞ বাংলা অনুবাদক ও ভাষ্যকার যে মন্তব্য করেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : ‘আনসারির অন্তর্ভেদী আত্মার আর্তি প্রাচ্য-প্রতীচ্যে অমুসলিমদের মনে যে দোলা দিয়েছে তার কিঞ্চিৎ আভাস দেয়া হলো। আত্মার অভিযাত্রায় আনসারি কুরআন-সুন্নাহর পূর্ণ তাঁবেদারিতে কামালিয়ত হাসিল করেন। তাওহিদ-রিসালতের আকিদায় লব্ধ ‘বেছাল’ (মিলন ও সংযোগ) র্শিকি সাধনায় অর্জন অসম্ভব। বহুত্বের তিমিরে আচ্ছন্ন আত্মার আলোকপ্রাপ্তি অনায়ত্তে থাকবেই। এ অবস্থায় তাওহিদি সাধকদের সঙ্গে অন্য পথের পথিকদের সমীকরণের প্রয়াস অসঙ্গত ও অসমীচীন। রাহমাতুল লিল আলামিনের তাওহিদি পয়গাম সারা বিশ্বে সকল মানুষের জন্য। এ ডাকে সাড়া দিলেই সঙ্কট নিরসন হবে। সে সঙ্কট ব্যক্তিসত্তার হোক, জাতিসত্তার হোক। তাওহিদ-শিরকের সমন্বয় প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে, হচ্ছে, হবেই। তাওহিদ হতে বিচ্যুত তন্ত্র-মন্ত্র মানবজাতির সীমাহীন যন্ত্রণার কারণ হয়েছে। তাওহিদ হতে সরে আসা এ ‘বাদ’ সে ‘বাদ’ মানবজাতিকে বরবাদ করেছে। ভোগোন্মাদ বর্তমান বিশ্বে আত্মার পুনর্বাসন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। নির্বাসিত আত্মার পুনরুদ্ধারে ইসলামের সুফি সাধক দরবেশদের কাব্যিক সম্পদের ব্যাপক প্রচার প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে’ (প্রিন্সিপ্যাল এএ রেজাউল করিম চৌধুরী, খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত, পৃ.১৩)।

রেজাউল করিম চৌধুরী অনূদিত এবং আনসারি রহ: রচিত আল্লাহ তায়ালার দরবারে নিবেদিত ‘মুনাজাত’-এর কয়েকটি পঙক্তি নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো-

‘If a lame dog
Finds admission at Thy gate,
And the weary are refreshed by Thy sight
No reasons have I for despair.’

‘খোঁড়া কুকুর পায় যদি
তোমার দুয়ারে আশ্রয়,
ক্লান্ত শ্রান্ত আর্তজন
তোমাতে যদি পায় শান্তি,
হতাশ হবার নেই কারণ।’

‘I live only to do Thy will,
My lips move only in praise of Thee,
O Lord, whoever becometh aware of Thee
Casteth out all else other than Thee.’
তোমার ইচ্ছা পালনেই আমি বেঁচে থাকি,
তোমার বন্দনায় রসনা মোর সদা সঞ্চালিত,
প্রভু হে, যে জন তোমায় জেনেছে
তুমি ছাড়া সব কিছুই ছেড়েছে সে।’

(Sardar Sir Jogendra Singh, The Persian Mystics : Ansari (The Wisdom of the East Series), London, 1951, pp.23,54; প্রিন্সিপ্যাল এএ রেজাউল করিম চৌধুরী অনূদিত খাজা আবদুল্লাহ আনসারি রহ:-এর মুনাজাত ও নসিহত, পৃ.১৬, ১৮)।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: