
গত ২০ মে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা। তবে গত ৯ এপ্রিল থেকেই দেশে পরীক্ষামূলকভাবে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা পরিচালনা করেছে স্টারলিংক। সে হিসেবে আজ শনিবার বাংলাদেশে স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা চালুর ১৫০তম দিন। দ্রুতগতির স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশে শুরু থেকেই স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা নিয়ে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা গেছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছেন। স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন ব্যবহারকারী।
আইএসপির চেয়ে ভালো সেবা
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর মাধ্যমে স্টারলিংক দেশের ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) ও মোবাইল ফোননির্ভর ইন্টারনেট সেবাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এ বিষয়ে ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে থাকা প্রযুক্তি উদ্যোক্তা সোহাগ হাসান বলেন, ‘আমি ফ্রিল্যান্সিংসহ বিভিন্ন কাজে স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। আমার এলাকায় অন্যান্য আইএসপির তুলনায় স্টারলিংক কয়েক গুণ ভালো সেবা দিচ্ছে। তুমুল বৃষ্টি বা ঝড় ছাড়া ইন্টারনেটের গতি কমে যায় না স্টারলিংকের। আমাদের মতো ফ্রিল্যান্সাররা স্টারলিংকের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারছেন। তবে শুরুর দিকে অনেকেই হুজুগে স্টারলিংকের সংযোগ নিলেও এখন তা বিক্রি করে দিচ্ছেন। আসলে সাধারণ ব্যবহারকারীদের ইউটিউব বা ফেসবুক চালানোর জন্য যে গতির ইন্টারনেট প্রয়োজন, তার চেয়ে অনেক বেশি গতির ইন্টারনেট পাওয়া যায় স্টারলিংকে। তবে সংযোগ ও ইন্টারনেটের দাম অনেক বেশি বলা যায়। হয়তো ভবিষ্যতে গ্রাহক বাড়লে দাম কমাতে পারে স্টারলিংক।’ নারায়ণগঞ্জের ফ্রিল্যান্সার হামিম হোসেন স্টারলিংকের শুরুর দিকের গ্রাহক। তিনি বলেন, ‘লোকাল ব্রডব্যান্ড বাদ দিয়ে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে স্টারলিংক ব্যবহার করছি। আমি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করি, স্টারলিংকের মাধ্যমে আমার বেশ কাজে গতি এসেছে। আমার বাসায় ৬ থেকে ৮টি যন্ত্রে স্টারলিংক ইন্টারনেট ব্যবহার করছি। আমি শুরুর দিকে ৬ হাজার টাকার প্যাকেজ নিলেও এখন ৪২০০ টাকার প্যাকেজ ব্যবহার করছি।’
বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ বলেন, স্টারলিংক স্যাটেলাইটনির্ভর উচ্চগতি ও সহজে স্থাপনযোগ্য সংযোগব্যবস্থা, যা বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগের নতুন দিকের সূচনা করেছে। অনেক শিক্ষার্থী ও তরুণ উদ্যোক্তা এটি ব্যবহার করে পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং, ই-কমার্স ও অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর কাজে যুক্ত হচ্ছেন। স্টারলিংক ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবা, ই-শিক্ষা ও ই-কমার্সে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।’
নতুন গ্রাহক টানছে স্টারলিংক, টিনের ছাদে অ্যানটেনা
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত ব্রডব্যান্ডের ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যার কারণে স্টারলিংক ব্যবহারে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই। অনলাইনে আধেয় (কনটেন্ট) নির্মাতা সৈয়দ আবিদ হুসাইন সম্প্রতি স্টারলিংকের সংযোগ নেওয়ার জন্য অর্ডার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি সাধারণ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে কাজ করেছি। ইন্টারনেট সেবায় অনেক সমস্যা দেখি। অনেক সময় কাজের প্রয়োজনের সময় ইন্টারনেট সংযোগ পাই না। স্থানীয় অফিসে ফোন করে বিরক্ত হতে হয়। আবার কোনো ভিডিও আপলোড-ডাউনলোডের সময় অনেক সমস্যা দেখি। এসব সমস্যার কথা বিবেচনা করে স্টারলিংক সংযোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি, ভালো ইন্টারনেট সেবা পাব।’ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা কর্মকর্তা আহসান কবীর বলেন, ‘আমরা পার্বত্য এলাকায় অনলাইন ক্লাসরুম পরিচালনার জন্য স্টারলিংক সেবা নিয়েছি। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী বর্তমানে স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবার মাধ্যমে অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিতে পারছে।’ বান্দরবান শহরে চার থেকে পাঁচটি স্টারলিংক রিসিভার ও প্রত্যন্ত লামা এলাকাতে স্টারলিংক ব্যবহার করতে দেখেছি। স্থানীয় অনেক তরুণ উদ্যোক্তা তাঁদের প্রয়োজনে স্টারলিংক ব্যবহার করছেন। বেশ কয়েকটি ফ্রিল্যান্সার প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের সুবিধার জন্য নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। প্রথম দিকে সংযোগ পেতে পেমেন্ট গেটওয়ে–সংক্রান্ত কিছুটা সমস্যা ছিল। এখন বাংলাদেশের যেকোনো কার্ড দিয়ে পেমেন্ট করা যায় বলে অনেকেই স্টারলিংকের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। কক্সবাজারের প্রত্যন্ত এলাকা যেমন উখিয়াতে বেশ কয়েকটি স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা তাদের কাজের জন্য স্টারলিংক ব্যবহার করছে। সেখানে ছয়-সাতটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্টারলিংকের মাধ্যমে পরিচালনা করা হচ্ছে। ২০ আগস্ট রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলায় হাসান শাহরিয়ার স্টারলিংক মিনি স্থাপন করেছেন টিনের ছাদের ওপর।
প্রতিযোগিতামূলক ইন্টারনেট সেবা গ্রাহকের সামনে
স্টারলিংকের স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট সেবার কারণে দেশীয় আইএসপি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা কেমন হবে, তা নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। এ বিষয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব কে বলেন, ‘গত ১৫০ দিনে দেশে দেড় হাজারের বেশি গ্রাহক স্টারলিংক সেবা ব্যবহার করছে। প্রায় সব জেলা থেকেই গ্রাহকেরাই এখন নিজেদের প্রয়োজনে স্টারলিংক ব্যবহার করছেন। শহর থেকে গ্রামের হাটবাজারে স্টারলিংক ব্যবহার করছেন অনেকেই। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা যৌথভাবে স্টারলিংক সংযোগ ভাগাভাগি করে ব্যবহার করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য কম দামে স্টারলিংক সেবার জন্য কাজ করছি আমরা। স্টারলিংক শুরু থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল, দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় শহর থেকে গ্রামে, উপকূল থেকে উত্তরে—সব জায়গায় মানসম্পন্ন ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা নিয়ে যাওয়া। ১৫০ দিনে সেই কাজ অনেকটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিকে স্টারলিংক কিট আনা-নেওয়ার কিছুটা সমস্যা থাকলেও এখন কোনো সমস্যা নেই। ভোক্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন মতামত গ্রহণ করছি আমরা। স্টারলিংক কালিয়াকৈর ও রাজশাহী হাইটেক পার্কে দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন বসানোর কারণে সেবার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। স্টারলিংক আসার পরে দেশের আইএসপিরা যে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে, সেখানে গুণগত মানে বেশ একটা পরিবর্তন আসছে। এখন আইএসপিরা গ্রাহকদের ১০ এমবিপিএস ন্যূনতম গতির ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এই সেবার মান ১৫ এমবিপিএস বা আরও ভালো হবে বলে আশা করছি আমরা। স্টারলিংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক দৌড়ে আমাদের আইএসপিগুলো গ্রাহক সেবা আরও উন্নত করবে। তবে আইএসপিগুলোর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এবং পরিকল্পনা সময়সাপেক্ষ বলে এ সময়ে মুঠোফোন–নির্ভর ইন্টারনেট সেবায় গতি তেমন বাড়েনি।’
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আরও বলেন, স্টারলিংকের সূত্র ধরে তিনটি পরিবর্তন হয়েছে। নতুন প্রজন্মের স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের উচ্চমান ও উচ্চগতির যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি ন্যূনতম ৫ এমবিপিএস থেকে ১০ এমবিপিএস করা হয়েছে। দেশে ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। দেশের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় ব্রডব্যান্ড সংযোগের আওতায় আছে আবার সব জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্কের ইন্টারনেট গতি কিছুটা দুর্বল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্টারলিংক দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রাকে অনন্য একমাত্রায় নিয়ে যাবে।
পরিবহনে কিছুটা সমস্যা
স্টারলিংকের সব যন্ত্রাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে। দেশে আসার পরে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানোর পর অনেক সময় পণ্যের প্যাকেট ছেঁড়া বা ভাঙা থাকে বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ব্যবহারকারী। স্টারলিংক বাংলাদেশ ইউজার কমিউনিটির সদস্য মোহাম্মদ ফরহাদ করিম বলেন, ‘স্টারলিংকের যন্ত্রাংশ ডিএইচএল কুরিয়ারের মাধ্যমে এলেও আমার কাছে মনে হয়েছিল আগে কেউ প্যাকেট খুলেছে। এমনকি পানিতেও ভিজেছিল বলে মনে হচ্ছিল। আর তাই আমি প্যাকেজ না খুলে ডিএইচএল ও স্টারলিংকে অভিযোগ করেছিলাম। যদিও স্টারলিংকের যন্ত্রাংশ চালুর পর কোনো ধরনের ইন্টারনেট সেবাজনিত সমস্যা পাইনি।’ জোবায়ের তৌসিফ নামের এক ব্যবহারকারী বলেন, ‘ডিএইচএল কুরিয়ারের মাধ্যমে আমিও কিছুটা ত্রুটিগ্রস্ত বাক্স পেয়েছিলাম।’ আরেক ব্যবহারকারী মোহাম্মদ সানাউল্যাহ বলেন, সাধারণত স্থানীয় কুরিয়ারের মাধ্যমে ডেলিভারি দেওয়ার সময় এমন ঝামেলা বেশি হয়।
গ্রাহকদের অভিযোগ
অনেক গ্রাহক মে ও জুন মাসে স্টারলিংকে অর্ডার করে এখনো পণ্য হাতে পাননি। স্টারলিংক অর্ডার থেকে শুরু করে সব গ্রাহকসেবায় ওয়েবসাইট–নির্ভর। এতে স্থানীয় গ্রাহকেরা কোনো সমস্যায় পড়লে যোগাযোগ করতে বিলম্বের মুখে পড়েন। জায়ান্ট মার্কেটার্স নামের একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মালিক মাসুম বিল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, ‘কুমিল্লার ঝাউতলায় আমার অফিস। এ বছরের এপ্রিল মাসেই আমি আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য স্টারলিংক অর্ডার করি। তখন দ্রুত হাতে পেয়ে যাই। আমার ৩০ জন কর্মী স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করছে। আমরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর সেবা নিয়ে কাজ করি। আমাদের গতিশীল ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়। তবে আড়াই মাস ধরেই স্টারলিংকের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যেসব পণ্য অর্ডার করা হচ্ছে, তা ঠিকমতো আসছে না। আমার ১৮ হাজার টাকা আটকে আছে। আমি আড়াই মাস আগে অর্ডার করলেও পণ্য হাতে পাইনি। শুধু আমি নই, অনেক ব্যবহারকারী একই সমস্যায় ভুগছেন। স্টারলিংকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কোনো সাড়া মেলেনি। এতে আমরা গ্রাহকেরা সমস্যায় পড়ছি।’
কৈখালিতে স্টারলিংক ইন্টারনেট
স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা এখন দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় মিলছে। সুন্দরবনের আধা কিলোমিটারের দূরত্বে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কৈখালি গ্রাম অবস্থিত। সেখানে স্টারলিংক ব্যবহার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় এক কলেজের প্রভাষক মো. গোলাম বারী বলেন, ‘এখনে যে ব্রডব্যান্ড আছে, তা খুবই দুর্বল। ওয়াই–ফাই দিয়ে সন্ধ্যার সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। কোনোভাবেই ব্রডব্যান্ডে স্পিড ভালো পাওয়া যায় না। এসব সমস্যা সমাধানে আমি স্টারলিংক সংযোগের জন্য অর্ডার করি গত ২৬ মে, আর বুঝে পাই ৩১ জুলাই। ডেলিভারির সময় বেশ দীর্ঘ। আমি সঙ্গে একটি মাউন্ট অর্ডার করলেও তা এখনো বুঝে পাইনি। অভিযোগ করার পরে স্টারলিংকের কাছ থেকে আমি ২৫ ডলার সার্ভিস ক্রেডিট পেয়েছি প্রথম মাসের বিল হিসেবে। আমার এলাকায় আমি প্রথম স্টারলিংক অর্ডার করছি। আমার এখানে ৩২০-৪৫০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছি আমি। আপলোড স্পিড ৪০-৭০ এমবিপিএস।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: