প্রধান লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান

২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২ জুন ২০২৫ ২২:০৬

Photo : Collected Photo : Collected

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষায় ভাতা ও উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসায় পরিবেশের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা সম্মুন্নত রাখার অঙ্গীকার করে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সোমবার বিকেলে অর্থ উপদেষ্টা টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই বাজেট পেশ করেন।

বাজেট বক্তৃতার শুরুতে অর্থ উপদেষ্টা একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণ করেন। একইসঙ্গে তিনি স্মরণ করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অকুতোভয় শহীদদের। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন তিনি। বলেন, ‘২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমাদের ওপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি।

তিনি বলেন, ‘আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সাথে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান এর পর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শীঘ্রই আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ।’

প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। যার সংস্থান হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস হতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা । আর ঘাটতি বাজেটের প্রস্তাব করা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা।

এই ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হবে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। এতে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হবে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে এক লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেওয়া হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার।

প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এক লাখ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা।

এবার প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি অর্থবছরের প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ—এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোন রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে।’

প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্ক-কর কমানোর ফলে চিনি, স্যানিটারি ন্যাপকিন, আইসক্রিম, ভূমি নিবন্ধন ফি, নিউজপ্রিন্ট পেপার, ক্যানসারের ওষুধ, ইনসুলিন, এলএনজি, টায়ার, দেশি তৈরি ই-বাইক, মাটির পাত্র-পেপার প্লেটস-অন্যান্য, কম্পিউটারের দেশে তৈরি বড় মনিটর, উড়োজাহাজ ভাড়া, লিথিয়াম-গ্রিফিন ব্যাটারিসহ আরো কিছু পণ্যের দাম কমতে পারে। এদিকে, শুল্ক-কর বাড়ানোর কারণে বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যেমন-সিগারেট, অনলাইন কেনাকাটা, রড, প্রসাধনী সামগ্রী, সাবান-শ্যাম্পু, শিশুদের খেলনা, দেশে তৈরি মোবাইল ফোন, গৃহস্থালি প্লাস্টিক সামগ্রী, এলপিজি, দেশে তৈরি এলপিজি সিলিন্ডার, ফ্ল্যাট, বলপয়েন্ট কলম, হেলিকপ্টার সার্ভিস, দেশে তৈরি ওয়াশিং মেশিন, দেশে তৈরি মাইক্রো ওভেন, দেশে তৈরি ইলেকট্রিক ওভেন, দেশে তৈরি ব্লেন্ডার-জুসার-মিক্সার-গ্রাইন্ডার, দেশে তৈরি ইলেকট্রিক কেটলি-ইস্ত্রি, দেশে তৈরি রাইস কুকার-প্রেসার কুকার, ব্লেড, দেশে তৈরি লিফট, দেশে তৈরি ফোর স্ট্রোক থ্রি-হুইলার যান, ওটিটি কনটেন্ট, বাণিজ্যিক ভবন (কমার্শিয়াল স্পেস), সেলফ-কপি পেপার-ডুপ্লেক্স বোর্ড-কোটেড পেপার, সুতা, ম্যানমেড ফাইবার, স্ক্রু-নাট-বোল্ট, সার্জিক্যাল কিটস, শিপ স্ক্র্যাপস গুডস, সিমেন্ট শিট, ক্রেডিট রেটিং সার্ভিস, থ্রি-হুইলার ব্যাটারি, সেটআপ বক্স ইত্যাদি।

এবারের বাজেটে প্রথমবারের মত যুব উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ‘তারুণ্যের উৎসব’ উদযাপনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।তিনি বলেন, তরুণ-যুবাদের দেশের উন্নয়নে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত করার জন্য এই বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে সারা দেশে সফল যুব উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সিলিং বৃদ্ধি করে ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছেন তিনি।

আপাতত প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে আমরা অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তব্যে বলেন, ‘এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সকল স্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে আমি আপনাদের সকলের সহযোগিতা চাই। ইনশাআল্লাহ্, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আলোকবর্তিকা’।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও তা এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত এপ্রিল মাসে মার্কিন প্রশাসন আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাবও আমাদের অর্থনীতির ওপর পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, সম্প্রতি যে বাজার ভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা হয়েছে, তার কোন নেতিবাচক প্রভাব আপাতত বাজারের উপর পড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও, এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে। এ সকল ঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

এর আগে সোমবার দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করা হয়।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: