ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে প্রায় ৮ বছর গোপন কারাগারে বন্দী ছিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশেম। ব্যারিস্টার আরমান নামেও পরিচিত তিনি।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে (এফটি) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যারিস্টার আরমান জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে তাকে নিয়ে টিউলিপকে প্রশ্ন করেন এক ব্রিটিশ সাংবাদিক। এর জেরে আরমানের ঢাকার বাসায় অভিযান চালান বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা তার স্ত্রীকে 'মুখ বন্ধ' রাখার হুমকি দিয়েছিলেন।
২০১৭ সালের ২৫ নভেম্বর লন্ডনে চ্যানেলের ফোরের এক সাংবাদিক টিউলিপ সিদ্দিককে ব্যারিস্টার আরমানের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি টিউলিপকে বলেন, একটি ফোন কলেই হয়ত আপনি তার (আরমান) অবস্থার বড় পরিবর্তন আনতে পারেন।
টিউলিপ এ সময় বলেন, 'আমি একজন ব্রিটিশ এমপি। আমাকে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ হিসেবে উপস্থাপন করা থেকে সতর্ক থাকুন'। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ তিন দিন পর, ২৮ নভেম্বর রাতে প্রচারিত হয়।
চ্যানেল ফোর নিউজের ওই ফুটেজটি প্রচারের কয়েক ঘণ্টা আগেই তার বাড়িতে অভিযান চালান র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় সশস্ত্র সদস্যরা বাড়িতে ঢুকে তার স্ত্রীর বিদেশি যোগাযোগের তথ্য জানতে চায়। আরমান জানান, পরিস্থিতি এমন ছিল যেন তারা কোনো সন্ত্রাসীকে খুঁজছে।
আরমান যুক্তরাজ্যে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন। এফটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলের কুখ্যাত গোপন বন্দীশালা 'আয়না ঘরে' তাকে আটক রাখা হয়েছিল। শতাধিক বন্দীর মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। ওই বন্দীশালায় বছরের পর বছর বন্দীরা আলো-বাতাস থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত ছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আরমান বলেন, 'আয়না ঘরে বন্দী জীবন ছিল মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।' হাসিনার পতনের পর গত ৬ আগস্ট সেই অন্ধকার কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি ।
মূলত চ্যানেল-ফোর নিউজের প্রতিবেদনটি সম্প্রচার বন্ধ করতে চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আরমানের স্ত্রীকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাজ্যে আরমানের আইনজীবী মাইকেল পোলক ফিন্যান্সিয়াল ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, 'এখানে একজন সংসদ সদস্যকে সঠিকভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে, অথচ এর প্রতিক্রিয়ায় এমন একটি নিরাপত্তা বাহিনীর হুমকি এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে মানুষকে গুম, নির্যাতন এবং হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে।'
এফটির একটি প্রতিবেদন অনুসারে, লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিক লন্ডনে যে ফ্ল্যাটের মালিক, যা তিনি কোনো অর্থ ছাড়াই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একজন ডেভেলপারের কাছ থেকে পেয়েছেন।
হ্যাম্পস্টেড ও হাইগেটের এমপি টিউলিপ এর আগেও আওয়ামী লীগের ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সম্পত্তিতে বসবাস করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে পূর্ব ফিঞ্চলিতে তার বর্তমান বাসভবন।
গত বছর সিটি মিনিস্টার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া টিউলিপ সোমবার মন্ত্রিসভার মানদণ্ডবিষয়ক উপদেষ্টার কাছে তার সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়টি উল্লেখ করেন। তার মতে, তিনি কোনো ভুল করেননি।
এদিকে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সোমবার শেখ হাসিনা এবং তার ১১ জন শীর্ষ সহযোগীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় জড়িত।
এছাড়া, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নতুন একটি তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা হাজার হাজার লোককে জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন।
এছাড়া, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শেখ হাসিনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে।
শেখ হাসিনার পরিবার ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থ পাচারের অভিযোগও অস্বীকার করেছে। হাসিনার ছেলে এবং উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় গত মাসে রয়টার্সকে বলেন, ১০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প থেকে বিলিয়ন ডলার পাচার করা সম্ভব নয়। আমাদের কোনো অফশোর অ্যাকাউন্ট নেই। আমি ৩০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছি, আর আমার খালা ও কাজিনরা যুক্তরাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন। এত বড় অঙ্কের অর্থ আমরা কখনো দেখিনি।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নতুন নেতৃত্বে এসেছে। হাসিনার সরকারের পতনের পর র্যাবের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন খসড়া করা হচ্ছে।
দীর্ঘ আট বছরের কারাবাস শেষে মুক্তি পাওয়া আরমান বলেছেন, বন্দীশালার অভিজ্ঞতা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারকে আহ্বান জানিয়েছেন টিউলিপের ওপর অর্পিত দায়িত্বের যোগ্যতা পুনর্মূল্যায়নের জন্য।
২০১৭ সালে অবশ্য চ্যানেল ফোর নিউজের এক সাংবাদিকের প্রতি আচরণ নিয়ে বিতর্কিত হওয়ার পর টিউলিপ ক্ষমা চেয়েছিলেন। তবে তিনি এবং তার দল লেবার পার্টি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
টিউলিপের একজন সহযোগী জানান, আরমান টিউলিপের নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা নন বা ব্রিটিশ নাগরিকও নন। তবে তার নির্বাচনী এলাকার কিছু বাসিন্দার অনুরোধে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে টিউলিপ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আরমানের বিষয়ে চিঠি দিয়েছিলেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: