২৩শ কোটি টাকার ৩ বছরের মেগা প্রকল্প

মেয়াদ বাড়িয়েও ৬ বছরে অগ্রগতি ১০ শতাংশ

মুনা নিউজ ডেস্ক | ১৩ জুন ২০২৩ ০৯:৩৮

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর : সংগৃহীত ছবি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর : সংগৃহীত ছবি



মেয়াদ বাড়িয়েও ছয় বছরে বাংলাদেশের সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ২৩শ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১০ শতাংশ। গত ২৭ মে এ প্রকল্পের বর্ধিত তিন বছর মেয়াদও শেষ হয়েছে। এর আগে কাজ শুরু করতে না করতে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত তিন বছর শেষ হয়।

প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি) বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) অনীহা ও অদক্ষতার কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। তারা প্রকল্পের জন্য অভিজ্ঞ পিডি নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি এক রকম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা-এখন প্রকল্পটি শেষ করতে কমপক্ষে ৫শ কোটি টাকার বেশি ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাকি প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ চালিয়ে নিতে প্রকল্পটির মেয়াদ চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে বেবিচক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে বিইউসিজি। তারা বলেছে, প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী, একতরফাভাবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো বা কোনো শর্ত পরিবর্তনের অধিকার কোনো পক্ষের নেই। এছাড়া নকশার ভুলের কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি না হওয়ায় আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। এ বিষয়ে গত ১৬ মে আরও একটি চিঠিতে বেবিচকের কাছে জবাব চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

জেট ফুয়েল ডিপো ও পূর্ণাঙ্গ টার্মিনাল ভবন নির্মাণসহ এই মেগা প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। তবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্র বলছে, এই দীর্ঘ সময়েও প্রকল্পের ১০ শতাংশও কাজ করতে পারেনি চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকশায় ত্রুটি থাকায় গ্যাঁড়াকলে পড়েছে প্রকল্পটি।

বেবিচক সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের মূল টার্মিনাল ও কার্গো ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। দৃশ্যমান হয়নি কোনো ভবনই। কোথাও ভবন নির্মাণ দূরে থাক, ঠিকমতো মাটি ভরাটও হয়নি। অথচ প্রকল্পের কাজ শুরু করার আগেই বেবিচকের কাছ থেকে ‘মবিলাইজেশন অ্যাডভান্স’ বাবদ ২১৩ কোটি টাকা তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেছেন, নকশার ভুলের কারণে যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। নতুন করে নকশা তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। ত্রুটি না ধরে যারা এই নকশা বুঝে নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা গেছে, মূলত নকশার ভুলের কারণে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি হয়নি। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নকশা জমা দেওয়া হবে। ফলে বর্ধিত মেয়াদেও কাজের অগ্রগতি হবে না বললেই চলে। ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর প্রকল্পটি সরকারের অনুমোদন পায়।

প্রকল্পের ত্রুটি খতিয়ে দেখতে গত বছর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত প্রকল্প পরিচালকের অনভিজ্ঞতা ও অনীহার জন্য পুরো প্রকল্পটি স্থবির হয়ে আছে। এর আগে প্রকল্পটি মন্থর গতিতে চলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। নিজ নির্বাচনি এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে ‘বিশেষ ব্যবস্থা ও উদ্যোগ’ গ্রহণের জন্য তিনি বিমান প্রতিমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছিলেন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রকল্পে পিডি হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুশাসন দেওয়া আছে। সেখানে বলা আছে, ওই পদের কর্মকর্তাকে অবশ্যই দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। বেবিচকের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো এভিয়েশন সেক্টরের সংশ্লিষ্ট বিধায় ওই পদে জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে বেবিচকের নিজস্ব জনবল থেকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু এই প্রকল্পে নিয়োগকৃত কর্মকর্তার এ ধরনের কোনো কারিগরি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই। তিনি একজন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। চাকরিজীবনে তার একমাত্র অভিজ্ঞতা হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ৭০টি গাড়ি কেনা। কিন্তু তারপরও তাকে রহস্যজনক কারণে ৬ বছর ধরে এ পদে রাখা হয়েছে।

বিমান মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের মেগা প্রকল্পের ৭৫ ভাগ কাজ হচ্ছে পূর্তসংশ্লিষ্ট। বাকি ২৫ ভাগ কাজ ইলেকট্রিক্যাল-মেকানিক্যাল ও যোগাযোগ যন্ত্রাবলির। অথচ যে কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তিনি একজন মেকানিক্যাল ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী। এভিয়েশনসংক্রান্ত বিষয়ে তার কোনো কারিগরি জ্ঞান নেই। তাছাড়া তিনি পেশাগত জীবনের ২০ বছর আগে প্রকৌশল পেশা ত্যাগ করে সরকারের প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ ধরনের প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার আইকাও (ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন)-এর অ্যানেক্স-১৪সহ অন্যান্য রুলস রেগুলেশন, এফএএ-এর (ফেডারেশন এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অ্যাডভাইজরি সার্কুলারসংক্রান্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। বর্তমান পিডির এ ধরনের কারিগরি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই।

 

সূত্র : যুগান্তর



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: