বাতিল হতে যাওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয়েছেন সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদরা। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করে কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো পোস্ট দিলে এই আইনে মামলা হওয়ার বিষয়টি ছিল অবধারিত। বাংলাদেশে এ ধরনের মামলা হয় অন্তত ১৯০টি। এ আইনকে বিরোধী মত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তাঁদের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা হলেও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক জামিন অযোগ্য মামলার আসামি হতেন। এ ধরনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ৯৭ জন সাংবাদিককে কারাবাস করতে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৯৪ জনের জামিনে মুক্তি মিললেও তিনজন এখনো কারাগারে।
আইজি প্রিজনস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন জানান, বর্তমানে ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনে ৪৬ জন এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় বন্দি রয়েছেন ৫০ জন, যার মধ্যে তিনজন সাংবাদিক।
এক শিশুর ছবি নিয়ে অনলাইনে কার্ড প্রকাশ করার জেরে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই সময় বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে।
২০২৩ সালের ৭ আগস্ট ঘোষণা দেওয়া হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি (ডিএসএ) এখন থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) নামে নতুন একটি আইন দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে দায়ের করা মামলাগুলো অব্যাহত থাকবে। অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের সংখ্যাই বেশি। আইনটি হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ২০২১ সালে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছে।
২০২৩ সালের ৫ জুন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের পর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ আইনে সারা দেশে সাত হাজার একটি মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি একই বছরের ৮ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। এর তিন দিনের মাথায় ১১ অক্টোবর এই আইনের অধীনে প্রথম মামলা হয়।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) একটি ওয়েবিনারে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাঁচ বছরের চিত্র নিয়ে কঠিন পরীক্ষা’ নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এক হাজার ৪৩৬টি মামলা করা হয়েছে। দেখা যায়, পাঁচ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় চার হাজার ৫২০ জন অভিযুক্ত এবং এক হাজার ৫৪৯ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ সময় মাসে গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় ২৪টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ২৬ জন। অভিযুক্তদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ৪৯৫ জন, সাংবাদিক ৪৫১ জন ছিলেন। এ ছাড়া অভিযোগকারীর প্রায় ৭৮ শতাংশই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সাংবাদিকরা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা বেশি অভিযুক্ত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মানহানির অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৯০টি। বেশির ভাগ মামলা করেছেন তাঁর সমর্থকরা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। ফেসবুকে পোস্ট বা মন্তব্য করার দায়ে এ আইনে মামলা হয়েছে ৯০৮টি। বাকি ৫২৮টি মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এই আইনে মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনো জেলা বাদ যায়নি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকায়। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ২৮ শিশুকে অভিযুক্ত করা হয় এবং ২২ শিশুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোগকারী ৮৫৯ জনের পেশা শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য ১৮৯ জন, রাজনীতিবিদ ৩৩৮ জন (আওয়ামী লীগের ২৬৩ জন, যা মোট অভিযোগকারীর ৭৭.৮১ শতাংশ)। প্রধানমন্ত্রীর মানহানির জন্য বছরভিত্তিক মোট মামলার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে একটি, ২০১৯ সালে ১৪টি, ২০২০ সালে ৬০টি, ২০২১ সালে ৬৪টি, ২০২২ সালে ৩৮টি এবং ২০২৩ সালে ১৩টি মামলা হয়েছে।
এ সময় মন্ত্রীদের মানহানির জন্য দায়ের করা মামলার সংখ্যা ৮০। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী করেছে আটটি, মন্ত্রীরা করেছেন ছয়টি, মন্ত্রীদের সমর্থনকারীরা করেছেন অবশিষ্ট ৬৬টি মামলা। এসব মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৩৩৭, আর গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬৮ জন। রাজনীতিবিদদের মানহানির দায়ে করা মামলার সংখ্যা ২১২। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী করেছে সাতটি, রাজনীতিবিদরা করেছেন ৯৩টি, রাজনীতিবিদদের সমর্থনকারীরা করেছেন অবশিষ্ট ১১২টি মামলা। এসব মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ৭৩৯ আর গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৩৬ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধ ও শাস্তিযোগ্য ২২টি ধারার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৬৯টি মামলা হয়েছে ২৫ ধারায়। এতে মোট অভিযুক্ত ৯০৫ জন। গ্রেপ্তার ১৮৫ জন। ২৯ ধারায় মামলা ২৬৭টি, মোট অভিযুক্ত ৮৮৮ জন, গ্রেপ্তার ১৫১ জন। ৩১ ধারায় মামলা ১৬৭টি, মোট অভিযুক্ত ৫৩৯ জন, গ্রেপ্তার ১৩০ জন। ৩৫ ধারায় মামলা ১৭৩টি, মোট অভিযুক্ত ৯৬১ জন এবং গ্রেপ্তার ১৯৭ জন। এসব মামলার সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, স্বচ্ছতার অভাব, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা, বিচারপূর্ব বন্দি বা আটক, শিশু-কিশোরদের আইনের আওতায় আনা এবং আইনের স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: