জাতিসংঘের গুম-বিষয়ক কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৩ আগস্ট ২০২৪ ২২:১৯

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’সহ গুমের বিভিন্ন ঘটনাও সামনে আসছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এতদিন গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবার ন্যায়বিচার পাননি। তবে এবার ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে শক্ত ভিত্তি তৈরি করতে কোনও আপত্তি (রিজারভেশন) ছাড়াই জাতিসংঘের গুম সংক্রান্ত কনভেনশনে পক্ষ (পার্টি) হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাইয়ের পর কেবিনেট সিদ্ধান্ত দিলে ৩০ আগস্টের মধ্যে অ্যাক্সেশনের মাধ্যমে ওই কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হবে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের জন্য সরকার বা এর কোনও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে জাতিসংঘ।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস। ওই দিবসের আগে কনভেনশনে পক্ষ হওয়ার একটি লক্ষ্য আছে সরকারের।’

‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দি প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স’— পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে ইতিমধ্যে দুটি বৈঠক করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এমন তথ্য জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমরা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, কোনও রিজারভেশন (আপত্তি) দেবো না।’

উল্লেখ্য, ওই কনভেনশনে মোট ৪৫টি ধারা আছে এবং পক্ষভুক্ত যে কোনও দেশ এর ‘এক বা একাধিক ধারা মেনে চলবে না’ বলেও তাদের সিদ্ধান্ত জাতিসংঘকে জানাতে পারে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘আমাদের ব্যবস্থায় একটি বিশাল পরিবর্তন চলে আসছে এবং অবশ্যই আমাদের কর্মপরিধিতে সেটির প্রতিফলন থাকতে হবে। এটি সাধারণ মানুষের চাওয়া ছিল।’

সারা বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের ৯টি কনভেনশন আছে। এর মধ্যে আটটি কনভেনশনেই পক্ষভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে শুধু গুম-বিষয়ক কনভেনশন।

এই কনভেনশনটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় এবং ৩২ দেশ এটি অনুস্বাক্ষর করার পরে ২০১০ সালে এটির অধীনে কার্যক্রম শুরু হয়। ভুক্তভোগী পরিবার ও এনজিওদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘে এটি গৃহীত হয়।

সারা বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বা অন্য ক্ষেত্রে গুমের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার কারণে এই কনভেনশনটি আনা হয়। গুম বন্ধ, এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি প্রতিরোধ এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়ার জন্য সামষ্টিক প্রচেষ্টাই হচ্ছে এই কনভেনশনের উদ্দেশ্য।

বর্তমানে বিশ্বের ৭৫টি দেশ এই কনভেনশনের সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এই কনভেনশনে অনুস্বাক্ষর করেছে; অর্থাৎ এটি তাদের অভ্যন্তরীণ আইনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এছাড়া ভারত শুধু এটি সই করেছে এবং তাদের অনুস্বাক্ষর করা বাকি আছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের পঞ্চশক্তির মধ্যে শুধু ফ্রান্স এটিকে অনুস্বাক্ষর করেছে।

এই কনভেনশনে গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই কনভেনশনটি সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, এটি দেখার জন্য জাতিসংঘের একটি কমিটি কাজ করে এবং এর সদস্য সংখ্যা ১০।

ওই কমিটি পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রের বিভিন্ন রিপোর্ট পরীক্ষা করবে। কনভেনশনটির ৩৩ ধারায় বলা আছে, যে পক্ষভুক্ত কোনও দেশে যদি নিয়মতান্ত্রিকভাবে গুমের ঘটনা ঘটে, তবে ওই দেশের পরিস্থিতি দেখার জন্য কমিটি সদস্যরা সফরও করতে পারে। যদিও এই ধারাটি পক্ষভুক্ত অনেক দেশ এই শর্ত মেনে নেয়নি।

এই কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হলে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা ন্যায়বিচার পাবে ও তাদের মানবাধিকার রক্ষা করা যাবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাবে।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ’এটি হবে বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। রাষ্ট্র কর্তৃক অত্যাচার থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করতে এই কনভেনশন বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’

‘রাষ্ট্রের নির্যাতনমূলক হয়রানি থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য এই দলিলের উদ্ভব হয়েছে’, বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এই কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেটি আরও জোরদার হবে। এছাড়া ‘কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চারের’ পরিপূরক হিসেবেও এটি বিবেচনা করা হয়ে থাকে বলে তিনি জানান।

যে-সব দেশ মানবাধিকারকে সম্মান দেয়, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও ভালো হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলার বিষয়ে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই কনভেনশনে পক্ষ হলে সেটি শক্তিশালী হবে।’

তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক গুম হলে এই কনভেনশনের মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেকানিজমের সহায়তা চাইতে পারে ভুক্তভোগীরা।’

এই কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হওয়ার পরে নতুন আইন তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন কনভেনশনের ৪ ধারা অনুযায়ী যে দেশ এটি মেনে চলবে তাদের এ বিষয়ে আইন থাকতে হবে জানিয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, ‘এর জন্য হয়তো নতুন আইন হতে পারে।’

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ কাওসার আহমেদ বলেন, ‘এই কনভেনশনে পক্ষ হলে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে গুমের আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে এবং এ ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচার করার জন্য নতুন আইনের দরকার হবে।’

আগে বিভিন্ন সময়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র বা পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের গুম বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলতেন, ‘এ ধরনের শব্দ আমাদের ফৌজদারি আইনে নেই’; যা যথার্থ ছিল না বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, ‘এই কনভেনশন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অথবা নয়, এমন যেকোনও গুমের ক্ষেত্রে অপরাধটির তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্বও রাষ্ট্রের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে কনভেনশন কমিটি হস্তক্ষেপ করতে পারে।’

সদস্য রাষ্ট্র যদি ওই কনভেনশন মেনে চলছে না বলে অভিযোগ থাকে, জাতিসংঘের গুম বিষয়ক সংক্রান্ত কমিটির পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক দল পর্যবেক্ষণে আসতে পারবে বলে তিনি জানান।

এছাড়া কনভেনশন কমিটি গুম হওয়া ব্যক্তির পক্ষ থেকে সরকার যেন ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে এমন নির্দেশ দিতে পারেন।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: