দীর্ঘ আট বছর পর গোয়েন্দা সংস্থার ‘গোপন বন্দীশালা’ থেকে মুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। ৫ আগস্ট সোমবার মধ্যরাতে তাঁদের রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ৬ আগস্ট মঙ্গলবার ভোরে তাঁরা পরিবারের কাছে ফিরেছেন বলে জানা গেছে।
বেশ কিছু দিন আগে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে গুমের শিকার রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সদরদপ্তরের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত সেই কুঠুরিতে বছরের পর বছর মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর সেই আয়নাঘরের সামনে মঙ্গলবার সকালে বিক্ষোভ করেছেন গুম হওয়াদের স্বজনেরা। স্বজনদের বিষয়ে বুধবার বিস্তারিত জানাবে ডিজিএফআই।
আয়নাঘর থেকে মুক্তি পাওয়া একজন জানিয়েছেন, এখনো অনেক মানুষ আয়নাঘরে আটক রয়েছেন। মঙ্গলবার সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেতে ডিজিএফআই সদর দপ্তরের সামনে ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে অন্তত ২৩ গুম হওয়া ব্যক্তির অর্ধশত স্বজন মানববন্ধন করেন। এ সময় তাদের হাতে গুম হওয়া মানুষের ছবি ছিল। তাঁরা ডিজিএফআই সদরদপ্তরে প্রবেশ করে স্বজনদের দেখতে চান, তবে তাঁদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
এ সময় ‘মায়ের ডাক’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস, বিশিষ্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলম এবং নারী অধিকার নেত্রী শিরিন হক ছিলেন। পরে তাঁরা ভেতরে গিয়ে ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
ডিজিএফআই তাঁদের জানিয়েছেন, এখানে আর কোনো আটক নেই, নিখোঁজেরা কোথায় রয়েছেন, সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে বুধবার জানানো হবে।
এ বিষয়ে সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, `আমরা ডিজিএফআইয়ের কাছে জানতে চেয়েছি, আর কে কে ভেতরে আছে? তবে তাঁরা জানিয়েছেন কেউ নেই। কিন্তু আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে, সেখানে এখনো অনেক মানুষ আটক আছেন, আমরা এরপর ভেতরে গিয়ে দেখতে চাইলে তাঁরা ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেননি।'
তিনি বলেন, ‘আমাদের ডিজিএফআই আগামীকাল এ বিষয়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাবেন। না জানালে আমরা ফের সেখানে যাব। কারণ আমরা জানতে পেরেছি, অনেক আটক এখনো সেখানে রয়েছেন। সব গুম হওয়া মানুষের বিষয়ে হিসাব নেওয়া হবে।’
সানজিদা ইসলাম তুলির ভাই বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। তিনি মায়ের ডাক-এর ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে গুম হওয়া মানুষকে ফেরত পেতে লড়াই করছেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর গতকাল সোমবার রাতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল আমান আযমী এবং ব্যারিস্টার মীর আহমদ আরমান বিন কাসেমকে দিয়াবাড়ীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁদের পরিবার উদ্ধার করে বাসায় নিয়ে যায়। আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির, মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত গোলাম আযমের ছেলে। আর ব্যারিস্টার আরমান জামায়াতে ইসলামীর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে।
পরিবারের পাশাপাশি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীও তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও আহমাদ বিন কাসেমের মুক্ত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে।
২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মিরপুরের বাসা থেকে ব্যারিস্টার আরমানকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
গতকাল সোমবার রাতে কর্নেল (অব.) সামসের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা রাজধানীর ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত এলাকায় অবস্থান নিয়ে সবার মুক্তি চান। রাতেই ওই দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আরমান মুক্তির পর জানিয়েছেন, আয়নাঘর খ্যাত বন্দিশালায় আরও অনেকেই রয়েছেন।
এরপরই গুম হওয়া মানুষের স্বজনেরা সকাল থেকে আয়নাঘরের সামনে জড়ো হতে থাকেন। মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে অংশ নেন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে হরিশ্চর এলাকা থেকে তাঁকে র্যাব পরিচয়ে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর খোঁজ মেলেনি।
সাইফুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম কোথাও নেই, ডিজিএফআই সেটাও বলেনি, আবার আছে তাও বলেনি। তাঁরা আগামীকাল বুধবার আমাদের বিস্তারিত জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আমি বিশ্বাস করি এবং যে দুজন ফিরে এসেছেন তাঁদের কাছেও শুনেছি, আয়নাঘরে অনেক লোক আছেন, তার মধ্যে আমার স্বামীও রয়েছেন।’
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস, বিশিষ্ট ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলম ও নারী অধিকার নেত্রী শিরিন হক ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: