বাস, থ্রি-হুইলার, মোটরসাইকেলসহ নানা যানবাহনের দুর্ঘটনায় বাংরাদেশে ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে ৫ হাজার ৬১৯ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। এ সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩৪ হাজার ৪৭৮ জন নিহত হয়েছে। সেই বিবেচনায় দেশটিতে শিক্ষার্থীদের প্রাণহানির হার ১৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।
আজ স্থানীয় সময় সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নিজস্ব কার্যালয়ে সড়ক দুর্ঘটনার এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ২০১১ সালে ১১ জুলাই একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে যায়। ওই ট্রাকে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষে বাড়ি ফিরছিল ৪২ শিক্ষার্থী। সে দুর্ঘটনায় তাদের সঙ্গে নিহত হয় আরও তিনজন। সে দুর্ঘটনায় ১৩তম বার্ষিকীতে এই প্রতিবেদন উপস্থাপন করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে ২ হাজার ৬৪১ জন (শতকরা ৪৭ ভাগ)। ১৮ থেকে ২৫ বছর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে ২ হাজার ৯৭৮ জন (শতকরা ৫৩ শতাংশ)।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১ হাজার ৫৩৪ জন শিক্ষার্থী পথচারী হিসেবে যানবাহনের ধাক্কা বা চাপায় নিহত হয়েছে। যানবাহনের যাত্রী হিসেবে নিহত হয়েছে ৭২১ জন শিক্ষার্থী। গত সাড়ে পাঁচ বছরে মোটরসাইকেল চালক বা আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে ২ হাজার ৭৮৩ জন (শতকরা হিসাবে ৩৭ দশমিক ৮৬ ভাগ)।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা বাইকচালক ও আরোহী হিসেবে নিহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা আঞ্চলিক ও মহাসড়কে বেশি ঘটেছে। গত সাড়ে পাঁচ বছরের দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, এ সময় গ্রামীণ সড়কে ১ হাজার ৩৩৯ জন, শহরের সড়কে ১ হাজার ৪৮৬ জন, আঞ্চলিক সড়কে ১ হাজার ৬৫১ জন, মহাসড়কে ১ হাজার ১৪৩ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নিহতদের মধ্যে ২৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ থ্রি-হুইলার দুর্ঘটনায়, ২১ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী পণ্যবাহী মোটরযানের চাপায়, ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাসচাপায়, ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বাইসাইকেল ও প্যাডেল রিকশা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর মানসিকতা এবং ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতাকে দুর্ঘটনার বড় কারণ হিসেবে দেখছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো টেকসই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে তা অনেকটা অবৈজ্ঞানিক ও সমন্বয়হীন।’
সড়ক পরিবহন খাতে নৈরাজ্য নিয়ে ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সড়ক পরিবহন খাতের স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই গোষ্ঠী নিজেদের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির স্বার্থে সড়কে বিশৃঙ্খলা বজায় রাখে। মাঝেমধ্যে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কমিটি গঠন ও সুপারিশ তৈরি করা হয়। কিন্তু কোনো সুপারিশই আলোর মুখ দেখে না। মূলত কমিটি গঠন এবং সুপারিশ তৈরির মধ্যেই দেশের সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ঘুরপাক খাচ্ছে।’
দেশটির নৈরাজ্যকর সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত টেকসই পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন ও সড়ক পরিবহন আইনের বাধাহীন প্রয়োগে গুরুত্বারোপ করে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সংবাদ সম্মেলনে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ সৈয়দ জাহাঙ্গীর, ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ফেরদৌস খান, ট্রেজারার ড. জাহিদুল ইসলাম, লিগ্যাল ইকোনমিস্ট মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: