কয়েক বছর ধরে বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে বারবার উঠে আসছে ঢাকার নাম। শব্দদূষণেও রয়েছে শীর্ষে। বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায়ও ঢাকার অবস্থান তলানিতে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহ। কেন বাংলাদেশের রাজধানী শহরের অবস্থান এত রুগণ হচ্ছে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
ঢাকা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল শহরগুলোর একটি। ৩০৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ শহরে দুই কোটির বেশি মানুষের বাস। ফলে অপরিকল্পিভাবে বাড়ছে নগরায়ন। আশঙ্কাজনক হারে কমছে ঢাকার সবুজ, ফাঁকা জায়গা।
প্রতি বছর বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকা প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের সহযোগী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। গত বছর জুনে ইআইইউ প্রকাশিত বিশ্বের বসবাসযোগ্য ১৭৩টি শহরের তালিকায় টানা দ্বিতীয় বছরের মতো ১৬৬তম অবস্থানে ঢাকা। অর্থাৎ, বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় সপ্তম অবস্থানে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো— এই পাঁচ সূচকের ওপর ভিত্তি করে বাসযোগ্য শহরের তালিকা তৈরি করে ইআইইউ।
২০২৩ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি ইআইইউ। তবে গত এক বছরে ঢাকার মানুষের জীবন-যাপনের মানের কোনো উন্নতি ঘটেনি বলে মনে করেন বাংলাদেশের পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা।
ঢাকা বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে থাকার প্রধান কারণ ঘনবসতি আর অপরিকল্পিত নগরায়ন। আর অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কোনো সমন্বয় নেই, জবাবদিহি নেই। ফলে আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠছে বাণিজ্যিক স্থাপনা। শহরে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে মানুষ সৃষ্ট ময়লা-আবর্জনা। এছাড়া বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ, ভয়াবহ যানজট, পয়োনিষ্কাশনের করুণ অবস্থা, জলাবদ্ধতা, রাস্তাঘাটের করুণ দশা পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা; অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। তাপমাত্র বৃদ্ধি, খরাপ্রবণতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো বলছে এ প্রতিপাদ্য যথার্থ। কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন।
ঢাকা শহরে দূষণ কমাতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ঢাকার বাসিন্দারা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ঢাকাকে দূষণমুক্ত করতে সরকারের সদিচ্ছা অনেক পরের ব্যাপার, ইচ্ছা আছে কি না তা নিয়েই তো আমার সন্দেহ হয়। আমি তো এখনো কার্যকরী আর সুনির্দিষ্ট কিছু করতে দেখলাম না সরকারকে দূষণ নিয়ন্ত্রণে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করা অসম্ভব নয়। এজন্য দরকার একটি স্বচ্ছ নগর দর্শন, যেখানে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সাম্যভিত্তিক আর জনমুখী করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক আর আমলাতান্ত্রিক প্রভাবের বাইরে রাখতে হবে। সেখানে নিরপেক্ষ পেশাজীবী নিয়োগ দিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়ে তবেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ক্ষমতা আর দায়িত্বে পরিবেশ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি।’
রাজউক প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) কেন ব্যর্থ হয় তা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের মানদণ্ড লাগবে, সভ্য শহরে যা থাকে তার সব আমাদের একই মানে বা পরিমাণে না থাকলেও কাছাকাছি মনে আর পরিমাণে আনতে হবে। জনগণের অংশগ্রহণ নিয়ে ঢাকা পুনরুদ্ধারের কাজ এখনই শুরু করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া যদি পারে, ঢাকাবাসী কেন পারবে না?’
স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো— এই পাঁচ সূচকের ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালে বাসযোগ্য শহরের তালিকা তৈরি করেছিল ইআইইউ। ওই বছর বিশ্বের ১৭৩টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৯তম। ২০১৯ সালে এই সূচকে ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৮তম। ২০২০ সালে করোনার কারণে এ সূচক প্রকাশ করেনি ইআইইউ। তবে ২০২১ সালের সূচকে ঢাকা ১৩৭তম অবস্থানে ছিল। ২০২২ সালে এক লাফে ১৬৬তম অবস্থানে চলে যায় ঢাকা। মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে যে শহর যত বেশি পায়, তালিকায় সেটির অবস্থান থাকে তত ওপরে।
ইআইইউয়ের এ তালিকায় ২০২২ সালে ১৬৬তম স্থানে থাকা ঢাকার পয়েন্ট ছিল ৪৩ দশমিক ৮। বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় একেবারে নিচ থেকে যৌথভাবে ঢাকার সঙ্গে সপ্তম স্থানে ছিল জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। ২০২২ সালে বিশ্বের শীর্ষ বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম ছিল অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। প্রথম স্থানে থাকা ভিয়েনার পয়েন্ট ৯৮ দশমিক ৪।
নগরের পরিবেশ নিয়ে নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)। গত ৪ মে ‘ঢাকায় তাপদাহ: নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয়’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপ করে বিআইপি। এই সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২৮ বছরে রাজধানী ঢাকার সবুজ এলাকা কমে মাত্র ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশে। যদিও নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ সবুজ এলাকা এবং ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয়-জলাধার থাকার কথা।
জানতে চাইলে অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কংক্রিট, যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে। এর সঙ্গে বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব। এজন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় তাপমাত্রা কমাতে নতুন ওয়ার্ডগুলোতে এখনো প্রচুর গাছ লাগানো দরকার।’
৩ জুন, সোমবার রাজধানীর শেরাটন হোটেলে ‘সেভ ইয়োর ব্রেথ-ক্লিন এয়ার ইম্পারেটিভস’ শীর্ষক নীতিনির্ধারণী সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। বায়ুর গুণমান উন্নতকরণে তথ্য-ভিত্তিক সমাধান এবং তার যথাযথ প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপে এ সংলাপ আয়োজন করে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) এবং শক্তি ফাউন্ডেশন।
এতে ‘বায়ুদূষণ একটি নীরব ঘাতক’ বলে মন্তব্য করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। একই সংলাপে বায়ুদূষণ রোধে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম পাঁচটি ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা অনুযায়ী, ডিএনসিসি এলাকায় ধূলাবাহিত বায়ুদূষণ রোধে নির্মাণস্থলে আচ্ছাদন ব্যবহার করা, বায়ুবাহিত সূক্ষ্ম কণা ছড়িয়ে দেয় এমন উপকরণ বহনকারী যানবাহনের জন্য উপযুক্ত আচ্ছাদন ব্যবহার নিশ্চিত করা, কালো ধোঁয়া নির্গমন হয় এমন অনুপযুক্ত যানবাহন নিষিদ্ধ করা, অপ্রয়োজনীয় পাতা এবং বর্জ্য পোড়ানো পরিহার করা, নালা ও খালের অবৈধ পয়োনিষ্কাশন লাইন বন্ধ করা।
যদিও ভৌগোলিক কারণে প্রতি বছর শীতের সময় ঢাকার বায়ুদূষণ বাড়ে। ফলে বায়ুদূষণের দিক থেকেও ঢাকা প্রায়ই থাকে শীর্ষে। গত শীতেও ঢাকাকে টানা শীর্ষ দশে থাকতে দেখা যায়। মার্চে এসেও ঢাকাকে শীর্ষে থাকতে দেখা যায়। গত ২২ মার্চ সকাল ৮টা ৫৬ মিনিটে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক থেকে জানা যায়, বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকার স্কোর ১৯০ অর্থাৎ ঢাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রয়েছে।
বায়ুদূষণের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল পাকিস্তানের লাহোর। এই শহরটির স্কোর ১৮৩ অর্থাৎ সেখানকার বায়ুর মানও অস্বাস্থ্যকর। তৃতীয় অবস্থানে সেনেগালের রাজধানী ডাকার। এ শহরের স্কোর ১৭১ অর্থাৎ সেখানকার বায়ুর মানও অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে কাজাখস্তানের আস্তানা। পঞ্চম অবস্থানে ভারতের দিল্লি।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অনুযায়ী, স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয় বায়ুর মান। সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ।
ঢাকার এ দূষণের প্রধান কারণ নির্মাণকাজ। যে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে সেসব নিয়ম পালনের তোয়াক্কা করতে দেখা যায় না। এর বাইরে ইটভাটা ও শিল্প কারখানার ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো দূষিত কণা বাতাসে মেশে।
এছাড়া যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ঢাকার রাজপথ। নগরে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে অহরহ। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সূত্রমতে, এখন ঢাকা শহরে যেসব বাস চলছে, তার অর্ধেকের অবস্থা খারাপ। একটা বাসের ‘ইকোনমিক লাইফ’ সাধারণত ১০-১৫ বছর পর্যন্ত হলেও অধিকাংশ বাসের আয়ুষ্কাল শেষ। ফলে ঠিকভাবে জ্বালানি পোড়াতে পারে না। তখন সেগুলোর ধোঁয়ার সঙ্গে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গত হয়।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) ‘বার্ষিক ফ্রন্টিয়ার্স রিপোর্ট-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে শব্দদূষণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর নির্বাচিত হয়েছে ঢাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে ইউএনএপি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য অনুমোদনযোগ্য শব্দসীমা মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। এছাড়া বাণিজ্যিক এলাকা ও যেখানে যানজট রয়েছে সেখানে এই মাত্রা ৭০ ডেসিবেল। ঘনবসতিপূর্ণ ও ব্যাপক যানজটের শহর ঢাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১১৯ ডেসিবেল।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: