ডলার রেটের তারতম্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটে আর্থিক হিসাব এলোমেলো হয়ে যেতে পারে

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৪ জুন ২০২৪ ১৬:৩৬

সংগৃহীত ছবি সংগৃহীত ছবি

 

বাংলাদেশে প্রায় এক মাস আগে ডলারের বিপরীতে ৭ টাকা কমানো হয়েছে টাকার দাম। কিন্তু আগামী অর্থবছরের বাজেট নথির আর্থিক প্রাক্কলনগুলোর সঙ্গে নতুন এই বিনিময় হারের সমন্বয় করা হয়নি। এর ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট প্রদানে হিসাব এলোমেলো হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা।

গত ৮ মে ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ব্যবস্থায় ডলারের আনুষ্ঠানিক মধ্যবর্তী দর ধরা হয়েছে ১১৭ টাকা। কিন্তু ডলার রেট ১১৭ টাকার বেশি হলেও আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ, ভর্তুকি ও প্রকল্প ব্যয়ের বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিনিময় হার ১১০ টাকা দরে হিসাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রাক্কলন করেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি ঋণদাতাদের ঋণ ডেবট সার্ভিসিংয়ের জন্য বাংলাদেশকে ৪.২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। প্রতি ডলারের দর ১১০ টাকা হিসাবে ডেবট সার্ভিসিংয়ের জন্য দিতে হবে ৪৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তবে ডলারের দাম ১১৭ টাকা হিসাব করলে তা ২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা বেশি হবে। বিনিময় হার হিসাবের এই তারতম্য কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের জ্বালানি তেল ও সার আমদানির জন্য সরকারি ব্যয়কে ব্যাহত করতে পারে।

বাজেট হিসাবে টাকার এই বড় অবমূল্যায়নকে সমন্বয় না করায় চিন্তিত অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বিনিময় হারের এই বিপুল ফারাক আগামী অর্থবছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব এলোমেলো করে দিতে পারে।

তবে আর্থিক কর্মকর্তারা বিষয়টি উপেক্ষা করে গেছেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় যখন বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত বিনিময় হার ছিল ১১০ টাকা। এই হিসাব ধরেইে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয়, জ্বালানি ও সার আমদানির ভর্তুকি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাঁদা পরিশোধে টাকার অঙ্কে বাজেট বরাদ্দ প্রাক্কলন করে মন্ত্রণালয়।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাজেট প্রণয়ন করার সময় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ডলারের যে রেট দিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ চেয়েছে, বাজেটে সে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ইআরডি এক্ষেত্রে ১১০ টাকা বিনিময় হার হিসেবে বরাদ্দ চেয়েছে।

একজন কর্মকর্তা বলেন, 'ইতিমধ্যে ডলারের রেট পরিবর্তন হলেও বাজেটের হিসাব-নিকাশে পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিদেশি ঋণ যেহেতু ডলারে পাওয়া যায়, তাই এক্সচেঞ্জ রেটের হেরফের হলেও বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণের পরিমাণ ঠিকই থাকবে।'

অর্থ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বাজেট প্রস্তাবের প্রায় এক মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালু করে বিনিময় হার ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে সার্কুলার করেছে। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল, এই রেট ধরে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকিসহ সামগ্রিক ব্যয়ের হিসাব প্রাক্কলন করা।

তিনি বলেন, 'আগামী অর্থবছরের বাজেটে ১১০ টাকা ডলার রেটে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ প্রাক্কলন করা হলে তিন মাসের মধ্যেই এসব হিসাব-নিকাশ এলোমেলো হয়ে যাবে। তখন এক খাতের বরাদ্দ আটকে রেখে অন্য খাতের অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে হবে। এতে সামগ্রিকভাবে বাজেটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে।'

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরও একই কথা বলেন। তার মতে, বিদ্যমান বিনিময় হারে বাজেট সাজাতে দুই দিনের বেশি সময় লাগত না।

'তাই অর্থ বিভাগের উচিত ছিল, এখনকার এক্সচেঞ্জ রেটে বাজেটের আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলন করা। তা না করায় আগামীতে বরাদ্দের তুলনায় ভর্তুকি, প্রণোদনা, বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে, যা সংস্থান করা কঠিন হতে পারে,' বলেন তিনি।

আগামী অর্থবছর বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা থাকতে পারে—এমন পূর্বাভাসে বাজেট প্রণয়ন করেছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের অর্থনৈতিক প্রভাব থাকবে বলে মনে করছে অর্থ বিভাগ। তবে ফেডারেল রিজার্ভ ও ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক নীতি সুদহার (পলিসি রেট) আর বাড়াবে না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার ধীরে ধীরে কমবে।

ক্রলিং পেগ সিস্টেম চালু করার ফলে ডলারের বিপরীতে টাকা স্থিতিশীল হবে বলে আশা প্রকাশ করে অর্থ বিভাগ প্রাক্কলন করেছে, নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম কমবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

আগামী বৃহস্পতিবার (৬ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এতে আগামী অর্থবছরে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনার পূর্বাভাস ছাড়াও মধ্যমেয়াদে আমদানিতেও প্রবৃদ্ধির আশাবাদের কথা উল্লেখ থাকছে বলে জানা গেছে।

 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: