মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা বাংলাদেশ সরকারের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা। ২০১৯ সাল থেকে খাদ্যমূল্য বিবেচনা করলে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি। আয় কম, কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। যার ভুক্তভোগী গরিব ও সাধারণ মানুষ। ধনী ও গরিবের বৈষম্য বেড়েছে। গরিবের আয় বাড়েনি। জিডিপিতে জাতীয় আয় বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের ভূমিকা রাখতে পারছে না।
২ জুন, রোববার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৩-২৪ : তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব কথা বলেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল্যস্ফীতিতে আমরা ৯ ও ১০ শতাংশে অবস্থান করছি। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার চেয়েও বেশি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা। যেমন- ২০১৯ সালের তুলনায় মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে ১৭ ভাগ, পাইজামের দাম ১৫ ও মোটা চাল ৩০ ভাগ। অর্থাৎ মুনাফাখোররা বেশি লাভ যেখানে করছে, যে পণ্য গরিব ও মধ্যবিত্তরা ব্যবহর করে এবং বাজারে বেশি বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের দেশ হয়েও বিলাসী দেশে পরিণত হয়েছি। আমরা আয় করি কম, কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। যার ভুক্তভোগী গরিব ও সাধারণ মানুষ। আমরা কোন অর্থনীতির দেশে রয়েছি? সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে। অনেক সময় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ট্যারিফ কমিয়ে দেয়, তার সুফল তোলেন এক ধরনের ব্যবসায়ীরা।
ধনী ও গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু অভ্যন্তরীণ আয় ২৬৭৫ ইউএস ডলার, আর মাথাপিছু জাতীয় আয় ২৭৮৪ ডলার। মাথাপিছু গড় আয় যতটুকু পেয়েছি, মূলত উচ্চ আয় করেন তাদের কারণে। গরিব মানুষদের কথা বিবেচনা করলে তাদের আয় কমে গেছে। এখানে বৈষম্য বেড়েছে। তাদের উন্নতি হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না। সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া একটি বড় কারণ। বিষয়টি সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারের ৭.৫ শতাংশ বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা তা অর্জিত হবে না বলে মনে করছি।
তিনি বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। কিন্তু জানুয়ারিতে তা সংশোধন করে সাড়ে ৬ শতাংশ। আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তা আরও কম প্রাক্কলন করেছে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে সরকার। জিডিপির বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের ধারাটি বাড়ছে না। বরং কমছে। জিডিপিতে জাতীয় আয় বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের ভূমিকা রাখতে পারছে না বা কম সহায়তা করছে। যতটুকু কর্মসংস্থান হচ্ছে তা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে বাড়ছে। যা আসলে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই কর্মসংস্থানে মজুরি ও নিরাপত্তার হুমকি রয়েছে।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রাজস্ব আদায়ের ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, যা গতবছরের জুলাই-জানুয়ারি হিসেবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। গত বছর নেতিবাচক ছিল। সেখান থেকে ইতিবাচক ধারায় ফিলে এসেছি, সেটা ভালো দিক। যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হয়, তাহলে ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। যা অর্জন করা অসম্ভব।
অন্যদিকে এনবিআরের ক্ষেত্রে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। আয়ের বড় অংশ হচ্ছে ভ্যাট ও শুল্ক থেকে। অভ্যন্তরীণ মূল্য বৃদ্ধির কারণে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থানের কারণে আমদানি শুল্ক কমেছে। এতোকিছুর পর আইএমএফের নির্দেশনা অনুসরণ করে সরকার যে রাজস্ব বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন হবে না বলে মনে করছি।
সিপিডি মনে করে, বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সরকার অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিচ্ছে, ফলে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধে রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এটা ভবিষ্যত মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে কর ফাঁকি ও কর এরিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। কর কাঠামোকে ডিজিটালাইজেন ও অর্থ পাচার বন্ধ করার দিকে নজর দিতে হবে। সরকারের প্রাথিকার প্রজেক্ট জনবান্ধব হতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য গাড়ি কেনা ও বিদেশ ভ্রমণ এটা বন্ধ করতে হবে। এই মুহূর্তে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের বিকল্প নেই।
রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রজেক্ট পেয়ে থাকেন। তাদের জন্য সময়, ব্যয় ও বরাদ্দ বৃদ্দি করা হয়। অর্থাৎ সরকারে ক্রয়ে যদি স্বচ্ছতা না আনা যায়, তাহলে সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনার সম্ভাবনা কম বলেও মনে করেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: