বাংলাদেশে বিখ্যাত সুইস প্রতিষ্ঠান নেসলের শিশুখাদ্য সেরেলাকে বাড়তি চিনি পাওয়া গেছে বলে উঠে এসেছে এক গবেষণা। সুইজারল্যান্ডের অলাভজনক বেসরকারি সংগঠন পাবলিক আই ও ইন্টারন্যাশনাল বেবি ফুড অ্যাকশন নেটওয়ার্কের যৌথ গবেষণা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশগুলোতেই এই প্রবণতা বেশি। এসব দেশে নেসলের ব্র্যান্ড নিডো বেশ পরিচিত। আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, শিশুদের জন্য নিডোর যেসব পণ্য আছে, তার সবগুলোতেই বাড়তি চিনি আছে।
পাবলিক আই ও ইন্টারন্যাশনাল বেবি ফুড অ্যাকশন নেটওয়ার্কের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের বাজারে নেসলের ৯টি পণ্য চালু আছে, যার প্রতিটিতেই বাড়তি চিনি আছে। গড়ে এসব পণ্য থেকে একটি শিশুকে সাধারণভাবে একবার যে পরিমাণ খাবার খাওয়ানো হয়, তাতে বাড়তি চিনির পরিমাণ প্রায় ৩ দশমিক ৩ গ্রাম।
বাংলাদেশ ছাড়াও ফিলিপাইন, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, ব্রাজিল, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতেও নেসলের শিশুখাদ্যে বাড়তি চিনির প্রমাণ মিলেছে। বিপরীতে, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলোতে এসব পণ্যে বাড়তি চিনির উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
নেসলের এমন দ্বিচারিতার বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারসরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্যের অধ্যাপক ও শিশু বিশেষজ্ঞ কারেন হফম্যান বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, কেন দক্ষিণ আফ্রিকায় বিক্রীত পণ্য উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে বিক্রি হওয়া পণ্যের চেয়ে আলাদা হওয়া উচিত।’
নেসলের এই আচরণকে উপনিবেশবাদী আখ্যা দিয়ে হফম্যান আরও বলেন, ‘এটি উপনিবেশবাদের আরেকটি রূপ এবং এটি সহ্য করা উচিত নয়।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, শিশুর খাবারে চিনি যোগ করার কোনো বৈধ কারণ নেই।’
পাবলিক আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা অমান্য করে গরিব দেশগুলোতে বিক্রি হওয়া শিশুদের দুধ ও সিরিয়াল জাতীয় পণ্যে চিনি ও মধু মেশায় বিশ্বের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্য সংস্থা নেসলে। শিশুদের দুধ ও সিরিয়ালে মেশানো এসব চিনি ও মধু স্থূলতা এবং বেশ কিছু দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণ।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিক্রি হওয়া নেসলের প্রস্তুতকৃত শিশুখাদ্যের নমুনা পরীক্ষার জন্য বেলজিয়ামের একটি পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছিল পাবলিক আই। নমুনা ও পণ্য প্যাকেজিংয়ের পরীক্ষার ফলাফলে দেখে গেছে, এক বা তার বেশি বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি দুধের ফর্মুলা ব্র্যান্ড নিডো এবং ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়সী শিশুদের জন্য সিরিয়াল-জাতীয় খাদ্য সেরেলাকে সুক্রোজ বা মধুর আকারে চিনি মেশানো হয়েছে।
যুক্তরাজ্যসহ প্রধান ইউরোপীয় বাজারগুলোতে অবশ্য শিশুখাদ্যে চিনি মেশায় না নেসলে। একটু বেশি বয়সী শিশুদের খাদ্য সিরিয়ালে অতিরিক্ত চিনি পাওয়া গেলেও ছয় মাস থেকে এক বছরের বাচ্চাদের জন্য নেসলের খাদ্যপণ্যে কোনো চিনি দেওয়া হয়নি। পাবলিক আইয়ের কৃষি ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ লরেন্ট গ্যাবেরেল বলেছেন, ‘নেসলেকে অবশ্যই এই বিপজ্জনক দ্বিচারিতার অবসান ঘটাতে হবে এবং বিশ্বের প্রতিটি অংশে তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য সমস্ত পণ্যে চিনি মেশানো বন্ধ করতে হবে।’
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে স্থূলতা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আফ্রিকায় ২০০০ সাল থেকে পাঁচ বছরের কম বয়সী অতিরিক্ত ওজনের শিশুর সংখ্যা প্রায় ২৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটি মানুষের বেশি ভুগছে এই সমস্যায়।
ইউরোপীয় অঞ্চলের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা বলে যে, তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য খাবারে কোনো শর্করা বা মিষ্টিজাতীয় উপাদান মেশানোর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। অন্যান্য অঞ্চলের জন্য বিশেষভাবে কোনো নির্দেশিকা তৈরি করা হয়নি। গবেষকেরা বলছেন, ইউরোপীয়দের জন্য এই নির্দেশিকা বিশ্বের অন্যান্য অংশের জন্যও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
ওজন বৃদ্ধি এবং দাঁতের ক্ষয়সহ বেশ কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে চার বছরের কম বয়সী শিশুদের অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাজ্য। মার্কিন সরকারের নির্দেশিকায় দুই বছরের কম বয়সীদের জন্য অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় এড়ানোর পরামর্শ রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল বেবি ফুড অ্যাকশন নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় লেখা প্রতিবেদনে পাবলিক আই বলেছে, বাজার গবেষণা সংস্থা ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী খুচরা বাজারে ১২০ কোটি ডলারের সেরেলাক বিক্রি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। শুধু ব্রাজিল ও ভারতেই বিক্রি হয়েছে ৪০ শতাংশ সেরেলাক।
গবেষকেরা খুঁজে পেয়েছেন যে, সেনেগাল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ছয় মাস বা তার বেশি বয়সী শিশুদের জন্য বিক্রি করা বিস্কুট স্বাদের প্রতিটি সিরিয়ালে ৬ গ্রাম চিনি মেশানো হয়েছে। কিন্তু সেই একই পণ্য সুইজারল্যান্ডে বিক্রি হয় না। ভারতে বিক্রি হওয়া সেরেলাকে গড়ে ২ দশমিক ৭ গ্রাম অতিরিক্ত চিনি মেশানো হয়েছে।
ব্রাজিলে বিক্রি হওয়া সেরেলাক মুসিলনের আটটি পণ্যের মধ্যে দুটিতে চিনি নেই। তবে বাকি ছয়টিতে প্রায় চার গ্রাম করে চিনি রয়েছে। নাইজেরিয়ায় বিক্রি হওয়া শিশুখাদ্যে গড়ে ৬ দশমিক ৮ গ্রাম পর্যন্ত বাড়তি চিনি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ডব্লিউএইচওর মেডিকেল অফিসার ডা. নাইজেল রলিন্সের মতে, ‘পাবলিক আইয়ের প্রতিবেদনে (নেসলের) দ্বিমুখী নীতি প্রকাশ পেয়েছে, যা মেনে নেওয়া যায় না।’
নেসলের এক মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা শিশুদের জন্য আমাদের পণ্যগুলোর পুষ্টির গুণগত মানে বিশ্বাস করি এবং শিশুদের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় উচ্চমানের উপাদানগুলো অগ্রাধিকার দিই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘শিশুখাদ্য অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। নেসলে সব সময়ই স্থানীয় বিধান ও আন্তর্জাতিক মানের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। রেসিপির তারতম্যগুলো সাধারণত স্থানীয় বাজারে উপাদানগুলোর প্রাপ্যতাসহ বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে।’
নেসলে কোম্পানি গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী শিশুখাদ্যে শর্করার মোট পরিমাণ ১১ শতাংশ কমিয়েছে বলেও জানান এই মুখপাত্র। তিনি আরও বলেন, ‘চিনির পরিমাণ আরও কমানোর জন্য কাজ চলছে। বিশ্বব্যাপী বাচ্চাদের জন্য দুধ থেকে সুক্রোজ এবং গ্লুকোজ সিরাপ বাজার থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: