রিজার্ভ চুরি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২ কর্মকর্তার দায় চিহ্নিত

মুনা নিউজ ডেস্ক | ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০২:২০

প্রতীকী ছবি প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন গভর্নরসহ ১২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অবহেলা ও অসতর্কতা চিহ্নিত করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অবশ্য এ ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তবে সিআইডি জানিয়েছে, তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ৮ বছর আগে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ইউএস ডলার চুরি করেছিল।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) সিস্টেমের নিরাপত্তায় অবহেলা ও অসতর্কতার কারণে রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি করতে সক্ষম হয়েছে হ্যাকাররা। এক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার জন্য তৎকালীন গভর্নরসহ ১২ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে সিআইডি।

এই কর্মকর্তারা হলেন একজন নির্বাহী পরিচালক (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), একজন মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে ডেপুটি গভর্নর), চারজন যুগ্ম পরিচালক (এদের মধ্যে দুজন বর্তমানে উপমহাব্যবস্থাপক, একজন যুগ্ম পরিচালক এবং অন্যজন অবসরে আছেন), তিনজন উপমহাব্যবস্থাপক (তাদের মধ্যে দুজন এখন মহাব্যবস্থাপক) এবং দুইজন উপপরিচালক।

সেই সময়ে গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালক ছাড়া বাকি কর্মকর্তারা ফরেক্স রিজার্ভ এবং ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং, আইটি অপারেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগ, পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ এবং ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিংস রুমের কর্মকর্তা ছিলেন। তারা ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে, সার্ভার রুম খোলা রেখে এবং অনুপস্থিত থাকার মাধ্যমে হ্যাকারদের একটি সুযোগ দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন রিজার্ভ সুইফট সার্ভার একটি সংবেদনশীল সিস্টেম। তা সত্ত্বেও, তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান সুইফটের মাধ্যমে রিয়েল টাইম গ্রেস সেটেলমেন্ট (আরটিজিএস) সংযোগ অনুমোদন করেন এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন। তদন্তকারীরা এটিকে অপরাধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আরটিজিএস হলো একটি বিশেষায়িত তহবিল স্থানান্তর ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে তহবিল তাৎক্ষণিকভাবে এক ব্যাঙ্ক থেকে অন্য ব্যাঙ্কে স্থানান্তর করা যায়।

তদন্তে আরও বলা হয়েছে, তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর-৪ আবদুল কাশেম সুইফটের মাধ্যমে আরটিজিএস সেবা দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। ফলে আরটিজিএস সেবা দেওয়ার ফাইলে আতিউর রহমান নিজেই স্বাক্ষর করেন।

এছাড়া সিআইডি কিছু দিককে অপরাধমূলক উদ্দেশ্য হিসাবে চিহ্নিত করেছে যার মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি ৪০ দিনের জন্য গোপন রাখা। একটি বিদেশী সংস্থার দ্বারা অপরাধের প্রমাণ নষ্ট করা এবং অপরাধপ্রবণ কর্মকর্তার দ্বারা সুইফট সার্ভার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখা।

৩ ফেব্রুয়ারি, শনিবার এ বিষয়ে একাধিকবার সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে এর আগেও সিআইডির তদন্তে আতিউর রহমান সম্পর্কে এমন তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। এই বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘একজন গভর্নর একা কোনো সিদ্ধান্ত নেন না, সেখানে একটি সিস্টেম কাজ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ চুরির ঘটনার শিকার ছিল। ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ঘটেছে। সরকার এই বিষয়ে একটি মামলা করেছে।'

এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, সুইফট সার্ভারের সঙ্গে আরটিজিএস সংযোগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহার ভূমিকা ছিল। আরটিজিএস সংযোগের কারণে সুইফট সার্ভারের নিরাপত্তা ব্যাহত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।

শুভংকর সাহা এখন অবসরে আছেন। এই বিষয়ে তার মন্তব্যের জন্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

সিআইডির তদন্তে যেসব কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের পর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, তদন্তে যে ১২জন কর্মকর্তার নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে মেজবাউল হকও রয়েছেন। তদন্তে দেখা গেছে, তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর দেশের কোনো তদন্ত সংস্থাকে না জানিয়ে দুটি বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আসেন। তিনি তাদের অপরাধের স্থান থেকে তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের নির্দেশ দেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। ফলে পর্যাপ্ত তথ্য ও প্রমাণ নষ্ট হয়েছে। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেজবাউল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। সুইফট পেমেন্ট সিস্টেমে প্রতারণার কৌশল অবলম্বন করে দুর্বৃত্তরা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করে। ফিলিপাইনের মাকাতি শহরে রিজাল ব্যাংকের একটি শাখায় চারটি অ্যাকাউন্টে এই টাকা জমা করা হয় এবং দ্রুত সেখান থেকে টাকা তুলে নেওয়া হয়।

পরে বিভিন্ন সময়ে ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার ফেরত আসে। ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এখনও রয়ে গেছে। ঘটনার ৩৯ দিন পর মতিঝিল থানায় মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের মধ্যে লেনদেনের জন্য সুইফট ব্যবহার করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ জন কর্মকর্তার সুইফট বার্তার মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতা রয়েছে। অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের (এবিডি) অধীনে একটি কক্ষে (ব্যাক অফিস) এই বার্তা বিনিময় হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রটি বলেছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, শ্রীলঙ্কা ও হংকং- এই ৮টি দেশের ৭৬ জনের নাম পাওয়া গেছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: