বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার অর্থায়ন নিয়ে থাকে সরকার। দাতাগোষ্ঠীদের অর্থায়নকৃত প্রকল্পে ধাপে ধাপে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় প্রকল্পে নকশা পরিবর্তন, ব্যয় বৃদ্ধি এবং সময়মতো কাজের অগ্রগতি না হলে দাতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়। কখনো তা অর্থায়ন বাতিলের পর্যায়েও চলে যায়। সবচেয়ে নমনীয় সুদে ঋণ দেয়া সংস্থা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নকৃত ১১টি প্রকল্পে ধীরগতি নিয়ে সম্প্রতি সংস্থাটির পক্ষ থেকে অসন্তোষ জানানো হয়েছে।
সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাংক, ইআরডি এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও হয়েছে। এতে প্রকল্পের কাজ ঠিক সময়ে শেষ করার আহ্বান জানিয়ে মেয়াদ না বাড়ানোর তাগিদও দিয়েছে সংস্থাটি।
ইআরডি সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অগ্রগতি, পরিকল্পনা অনুয়ায়ী এগোয়নি। এখন কভিড-১৯-এর কোনো প্রভাব না থাকায় প্রকল্পের কাজ এবং কেনাকাটা যথাসময়ে করার জন্য তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর প্রকল্প শেষ করতে নতুন করে সময় বৃদ্ধি না করতে বলেছে সংস্থাটি।
নাম প্রকাশ না করে বৈঠকে উপস্থিত থাকা ইআরডির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কভিড-১৯ এবং নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। মূলত এ দুই কারণে যথাসময়ে কাজের অগ্রগতি হয়নি। আর ভূমি অধিগ্রহণের কারণে প্রকল্পের গতি কমে আসে বলেও সভায় আলোচনা হয়েছে।
ধীরগতির হিসেবে চিহ্নিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ছিল ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার মানেজমেন্ট (সিএসএডব্লিউএম) প্রকল্প। জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ১০৬ কোটি টাকার প্রকল্পে ৮৫ কোটি টাকা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। ২০২১ থেকে ২০২৫ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়নি। প্রকল্পটির মাধ্যমে জলবায়ু স্মার্ট প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় সেচের পানি ব্যবহার দক্ষতা শতকরা ৫০ শতাংশ সাশ্রয়ী করার কথা।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মুহাম্মদ রাশেদ ইফতেখার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মৎস্য বিভাগ এখনো জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। স্থানীয় জেলা প্রশাসনসহ অনেক অফিস এতে জড়িত। কাজটি চ্যালেঞ্জিং। তবে জমি অধিগ্রহণ শেষ হলে দ্রুত কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে। কভিডের সময়ে অর্থছাড়েও বিশ্বব্যাংক দেরি করেছিল।’
৪৯১ মিলিয়ন ডলারের হায়ার এডুকেশন এক্সিলারেশন অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে ১৯১ মিলিয়ন ডলার। উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ইউজিসি। ২০২১ সালের জুনে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২৬ সালে। দক্ষ স্নাতক তৈরি, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নারী শিক্ষার উৎকর্ষে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রকল্পটির অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ইউজিসির উন্নয়ন বিভাগের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এছাড়া কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২১ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। যেখানে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। তবে প্রকল্পটির বিষয়ে বৈঠকের আলোচনা নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা নুসরাত জাহান।
এদিকে ঢাকার স্যানিটেশন উন্নতির একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ওয়াসা। এটিও ছিল ধীরগতির প্রকল্পের তালিকায়। আরো ছিল লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, ক্যাশ ট্রান্সফার মডার্নাইজেশন প্রজেক্ট, এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জব, বাংলাদেশ রিজিওনাল ওয়াটারওয়ে ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট, বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রজেক্ট। জ্বালানি বিভাগের পাওয়ার সিস্টেম রিলাইয়েবিলিটি অ্যান্ড ইফেসিয়েন্সি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট। এসব প্রকল্পের গতি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
সংস্থাটির প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নে ৫৬ প্রকল্প চলমান রয়েছে বাংলাদেশে। আর সদ্য অনুমোদন পাওয়াসহ মোট ৭০টি প্রকল্প সক্রিয় রয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের গড় সময় সাত বছর হওয়ায় অংশীদারত্ব কাঠামোর কার্যকর বাস্তবায়নের বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির ২০২২-২৩ থেকে ২০২৬-২৭ অর্থবছরের জন্য কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের প্রস্তুতি ও অনুমোদনের জন্য সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া ‘খুব জটিল ও ধীর’। গত ২৭ এপ্রিল কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্কের অনুমোদন দেয় বিশ্বব্যাংকের বোর্ড। সেখানে প্রকল্পের ধীরগতির এসব বিষয় উঠে আসে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: