তিন বছর ধরে বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষে রয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত শহরের তালিকাতেও ঢাকার নাম আছে ওপরের দিকে।
তবে এই ক্ষতি মোকাবিলায় বিশ্বের যে কটি দেশ বৈশ্বিক তহবিল পাচ্ছে, সেই তালিকাতেও বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। আর ঢাকা শহর রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ বেশি অর্থ পেয়েছে।
গতকাল ৩০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ক্লাইমেট পলিসি ইনিশিয়েটিভ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বায়ুর মানবিষয়ক সংস্থা ক্লিন এয়ার ফান্ডের অর্থায়নে গবেষণাটির সঙ্গে ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপি, ওয়ার্ল্ড চিলড্রেন ফান্ডসহ মোট ছয়টি সংস্থা যুক্ত ছিল। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে নির্মল বায়ুর জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যাংকসহ মোট ১০টি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার দেওয়া তহবিল বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে উন্নয়ন সহায়তাদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি ১ হাজার ডলার সহায়তার মধ্যে ৭ ডলার ওই খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে ওই সহায়তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৯ সালে এসে সর্বোচ্চ ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপরের দুই বছর আবার তা কমতে থাকে। মূলত কোভিড–১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর ওই তহবিলে অর্থ কমে আসে। ২০২০ সালে তা আবারও বাড়লেও পরের বছর (২০২১) কিছুটা কমে। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বৈশ্বিক ওই তহবিলের ৮৬ শতাংশ (১২ বিলিয়ন ডলার) পায় এশিয়ার পাঁচটি দেশ।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, ওই তহবিলের ৩৭ শতাংশ পেয়েছে চীন, ২০ শতাংশ ফিলিপাইন ও ১৭ শতাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ। মঙ্গোলিয়া ও পাকিস্তান ৬ শতাংশ করে পেয়েছে। এই সব দেশ বায়ুদূষণ রোধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বায়ুদূষণে ওপরের দিকে থাকার পরও ভারত ও নেপাল মাত্র ১ শতাংশ বরাদ্দ পেয়েছে। আর বিশ্বের বড় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্মল বায়ুর তহবিল পেয়েছে চীনের বেইজিং শহর, ২৭ শতাংশ। এরপরেই ৯ শতাংশ তহবিল পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক প্রধান প্রশাসক ও নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক প্রতিবেদনে বলেন, বিশ্বের সরকারগুলো বায়ু নির্মল করার স্মার্ট উদ্যোগ নিলে তার সুবিধা জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষাতেও পাওয়া যাবে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। কারণ, বিশ্বের স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর শিশুরা বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বছর প্রকাশ করা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক গবেষণা ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স, ২০২৩’ বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকার চূড়ায় রয়েছে বাংলাদেশ। চার বছর ধরে এমন অবস্থান দেশটির। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে দূষিত বায়ুর দিক থেকে ঢাকা ও দিল্লি এক ও দুই নম্বরে ওঠানামা করছে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত প্রতি ঘনমিটারে বাতাসে সর্বোচ্চ দূষণকণার যে মান, অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি তার চেয়ে ১৪ থেকে ১৬ গুণ বেশি।
ক্লাইমেট পলিসি ইনিশিয়েটিভের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফ্রিকা মহাদেশে বায়ুদূষণ মোকাবিলায় তহবিল গেছে মাত্র ৫ শতাংশ। দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে তা মাত্র ১ শতাংশ।
বায়ুদূষণের কারণে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরতে গিয়ে গবেষণাটিতে বলা হয়, বায়ুদূষণ বর্তমানে মানবস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত হুমকি। বায়ুদূষণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনকে দ্রুততর করছে ও জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে এবং শ্রমশক্তি কমিয়ে দেওয়াসহ সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করেন ভারতের দিল্লি ও কলকাতার বাসিন্দারা। এরপর রয়েছে নাইজেরিয়ার কানো, পেরুর লিমা ও বাংলাদেশের ঢাকা শহর। তবে নির্মল বায়ুর জন্য ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পেয়ে তহবিলে শীর্ষে রয়েছে চীনের বেইজিং শহর। তারপরেই ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। পাকিস্তানের করাচি অর্ধবিলিয়ন ডলার পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে।
বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক সমস্যার সমাধান তহবিলের অভাবে করতে পারি না। বায়ুদূষণ মোকাবিলার জন্য আমরা বেশ ভালো পরিমাণে অর্থ পেয়েছি। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বায়ুর মানের উন্নতি না হওয়ায় ওই অর্থের ব্যবহার নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সঠিকভাবে এ অর্থ ব্যবহার না করলে জনগণের ভোগান্তি এবং সমস্যা যেমন একদিকে বাড়বে, অন্যদিকে ভবিষ্যতে ওই সমস্যা বেড়ে গেলেও এ বিষয়ে তহবিল পাওয়া কঠিন হবে।’
প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে হৃদ্রোগ, ফুসফুসের ক্যানসার, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া ও নিউমোনিয়ার মতো রোগ দ্রুত বাড়ছে। এ ধরনের রোগ বেড়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা করার চেয়ে বায়ুদূষণ রোধ করে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: