বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্বভাবতই গণমাধ্যমে অনেক কলাম, মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া এসব কলাম লেখকদের মধ্যে আছেন অনেক ‘অস্তিত্বহীন বিশেষজ্ঞরা’ও। বার্তা সংস্থা এএফপি এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এসব কলাম লেখকদের পরিচয় তো বটেই, ব্যবহৃত ছবি নিয়েও নানা অসঙ্গতি ও জালিয়াতি খুঁজে পেয়েছে এএফপি।
এফএফপির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ছাড়াও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে এসব অস্তিত্বহীন লেখকের কলাম।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসকল তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করে মতামত–নিবন্ধ প্রকাশ করছেন। তাদের কেউ কেউ নিজেদের পশ্চিমা বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচয় দেন, কেউবা নকল ছবি ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে আছে ভারতীয় মডেলের ছবিও। অন্য বিশ্লেষকের নামে ভুয়া উদ্ধৃতি ব্যবহার করার প্রবণতাও দেখা গেছে এসকল কলামে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আল মামুন এএফপিকে বলেন, এটি সমন্বিত প্রভাব খাটানোর চেষ্টা। এসব নিবন্ধ মূলত বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থনে বয়ানকে বিকশিত করছে।
এএফপির প্রতিবেদন বলছে, এসব নিবন্ধের বেশ কিছু ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন অনলাইনে প্রকাশ করা হয়েছে যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘নেতিবাচক প্রচারণা’ রুখতে ‘ভালো কলাম লেখকদের’ এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা ‘অস্তিত্বহীন বিশেষজ্ঞের’ নিবন্ধের বিষয়ে জানতে এএফপি পররাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বলে জানিয়েছে। তবে তারা কোনো উত্তর দেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এএফপিকে বলেন, তার হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই।
এএফপির প্রতিবেদনে এমন সাত শতাধিক নিবন্ধ বিশ্লেষণ করার কথা জানিয়ে বলা হয়েছে ৬০টির বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এগুলো প্রকাশিত হয়েছে। ৩৫ জনের নামে প্রকাশিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই নামগুলো ব্যবহার করে অনলাইন প্রথম কোনো লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই নিবন্ধের অনেকগুলো বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও আপলোড হয়েছে। এই ৩৫ লেখকের অনেককেই কট্টর চীনপন্থী ভূমিকায় দেখা গেছে। নিজেদের লেখায় ওয়াশিংটনের তীব্র সমালোচনা করেছেন তারা।
অবশ্য, এএফপির অনুসন্ধানে এই ৩৫ জন বিশেষজ্ঞের বাস্তবে অস্তিত্ব রয়েছে কি না, তা সম্পূর্ণভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে দেখা গেছে, গত বছরই প্রথম অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে তাদের অনেকের লেখা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের কারোরই অস্তিত্ব নেই। বিশ্বের স্বীকৃত কোনো জার্নালে তাদের গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়নি।
৩৫ জন বিশেষজ্ঞ লেখকের মধ্যে ১৭ জন নিজেদের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন পশ্চিমা ও এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে পরিচয় দিয়েছেন। তবে এএফপির অনুসন্ধানী প্রতিবেদকেরা এর কোনো সত্যতা খুঁজে পাননি। এর মধ্যে ৯ বিশেষজ্ঞ লেখক নিজেদের বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে পরিচয় ব্যবহার করেছে। এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার ইউনিভার্সিটি, কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটি, সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন ইউনিভার্সিটি এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এসব লেখককে চেনে না। তাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসব নামের কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততা নেই।
এএফপি বলছে, সন্দেহভাজন এক লেখকের বিষয়ে জানতে এএফপির পক্ষ থেকে ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আমরা আমাদের নথিপত্র ঘেঁটে দেখেছি, এই নামের কেউ আমাদের নথিপত্রে নেই।
তথাকথিত আটজন লেখক নিবন্ধে নিজেদের যে ছবি ব্যবহার করেছেন, তা ভুয়া—অনুসন্ধানে এমনটাই জানিয়েছে এএফপি। এসব নিবন্ধে জনপ্রিয় ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারসহ ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করা অন্য মানুষের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
এমনকি এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একই নিবন্ধ ইংরেজি ও বাংলায় ভিন্ন লেখকের নাম ব্যবহার করে প্রকাশ করা হয়েছে।
এসব লেখকের মধ্যে একজনের নাম ব্যবহার করা হয়েছে ডরিন চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে অন্তত ৬০টি কলাম তার নামে অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে যেখানে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রশংসা করা হয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বন্দুক হামলার কথাও উঠে এসেছে এসব কলামে।
ডরিন চৌধুরীর যে ছবি প্রকাশ করা হয়েছে সেটি ভুয়া। ওই ছবি ভারতীয় একজন অভিনেত্রীর। নিজের পরিচয় হিসেবে ডরিন চৌধুরী বলেছেন, তিনি নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই নামে তাদের কোনো নিবন্ধিত শিক্ষার্থী নেই।
ব্যাংকক পোস্ট এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের একটি ব্লগ পোস্টে নিবন্ধ লেখা হয়েছে ফুমিকা ইয়ামাদার নামে। যেখানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার পরিচয় দেয়া হয়েছে। এএফপির অনুসন্ধান বলছে, এই নামে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে নথিভুক্ত কেউ নেই। এমনকি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজ বিষয়ে গবেষণার আলাদা কোনো ক্ষেত্র নেই।
এছাড়া অনেক নিবন্ধে কোনো বিশেষজ্ঞ–বিশ্লেষকের এমন মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যা ওই ব্যক্তি কখনোই বলেননি বা লিখেননি। নেদারল্যান্ডসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের অধ্যাপক জেরার্ড ম্যাককার্থি জানান, মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে ‘পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর লেখক পৃথ্বীরাজ চতুর্বেদী নামের একজন। ওই নিবন্ধে তাঁর (ম্যাককার্থি) একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। ম্যাককার্থির ভাষ্য, এ উদ্ধৃতি সম্পূর্ণ বানোয়াট।
‘অস্তিত্বহীন’ এমন বিশেষজ্ঞের নিবন্ধ প্রকাশের ঘটনা নিয়ে এএফপি বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক ও সম্পাদকের মতামত জানতে চায়। তারা বলছেন, লেখকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা প্রভাবশালী কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত লেখা দেখে সরল বিশ্বাসে তারা এসব ছেপেছেন।
এএফপিকে ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ফিচার সম্পাদক মুবিন এস খান বলেন, আমরা লেখকদের পরিচয়ের ওপর আস্থা রেখেছিলাম। অন্যদিকে নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবির বলেন, ২০২৩ সালের শুরুর দিকে তার কাছে কিছু মতামত–নিবন্ধ পাঠানো হয়েছিল যার বেশিরভাগ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে লেখা। এসব লেখার কিছু তিনি তার পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। পরে প্রকাশ করা বন্ধ করে দেন।
নূরুল কবির এএফফিকে বলেন, তার মনে হয়েছিল, এসব লেখকদের অনেকে ভাড়াটে। কিংবা এসব লেখক কারও স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করছেন। পরে লেখকদের পরিচয় না পেয়ে অবাক হন তিনি। তাই লেখা প্রকাশ বন্ধ করে দেন।
নূরুল কবির আরও বলেন, মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচারের এই যুগে লেখকদের পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আমার আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: