বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন আলোড়ন:

তারেক রহমানের ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজর

মুনা নিউজ ডেস্ক | ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:২০

ফাইল ছবি ফাইল ছবি

দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বৃহস্পতিবার তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কেবল দেশের রাজনীতিতে নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এক বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার ৩০০ ফিট (৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়ে) এলাকায় আয়োজিত জনসমুদ্রে তাঁর দেওয়া “আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান” (আমার একটি পরিকল্পনা আছে) শীর্ষক বক্তব্যটি বিশ্ব গণমাধ্যমে এক নতুন কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।

বিশ্বের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তনকে ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে অভিহিত করেছে। বেশিরভাগ মিডিয়াতে তার দেশে ফেরাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ, জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে উগ্রবাদী ও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীগুলো যখন নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে আসন্ন নির্বাচন বানচাল করে দেশকে অস্থিতিশীল ও ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণে তৎপর তখন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের প্রত্যাবর্তনকে আশার আলো হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে উল্লেখযোগ্য গণমাধ্যমগুলোতে।

রয়টার্স ও আল জাজিরা উল্লেখ করেছে, তারেক রহমানের সরাসরি নেতৃত্বে বিএনপি এখন আরও ঐক্যবদ্ধ। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক শূন্যতা ও অস্থিরতা কাটিয়ে একটি শক্তিশালী নেতৃত্বের উপস্থিতি দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আল জাজিরা তারেক রহমানকে বাংলাদেশের "সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলীয় নেতা" হিসেবে অভিহিত করে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর লাইভ কভারেজ প্রচার করেছে। এছাড়াও গণমাধ্যমটি তাকে একটি 'দীর্ঘকালীন শাসক পরিবারের উত্তরাধিকারী' এবং দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দলের নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছে।

বিবিসি ও এএফপি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, ১৭ বছর পর প্রধান বিরোধী দলের শীর্ষ নেতার ফেরা বাংলাদেশে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করেছে, যা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাদের প্রধান শিরোনাম করেছে— ‘‘বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা নেতা ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে দেশে ফিরলেন।’’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারেক রহমানের এই ফেরা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। আর আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, ‘‘নির্বাচনের আগে নির্বাসন থেকে ফিরলেন বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী।’’

দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং ডেইলি সাবাহ তারেক রহমানের ‘ইনক্লুসিভ বাংলাদেশ’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের আহ্বানের প্রশংসা করেছে। তাঁর বক্তব্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তারেক রহমান তাঁর ভাষণে ‘‘কোনো প্রতিশোধ নয়, বরং আইনের শাসন’’ প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করেছেন, তা রয়টার্স অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে প্রচার করেছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি দূর হয়ে শান্তির বার্তা ছড়িয়েছে বলে তারা মনে করে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি সহ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো তারেক রহমানের ফেরার পর ভারতের সাথে সম্পর্কের সম্ভাব্য পরিবর্তনের ওপর আলোকপাত করেছে। ভারতীয় বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমান যে ‘‘জাতীয় স্বার্থকে সবার উপরে’’ রেখে সবার সাথে সুসম্পর্কের কথা বলেছেন, তা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও দীর্ঘমেয়াদী কূটনৈতিক সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। ভারতীয় এই শীর্ষ দৈনিক তারেক রহমানের বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে শিরোনাম করেছে— ‘‘আই হ্যাভ এ প্ল্যান: ১৭ বছর পর বাংলাদেশে ফিরে মার্টিন লুথার কিংকে স্মরণ করলেন বিএনপির তারেক রহমান।’’

দ্য হিন্দু লিখেছে, ‘‘জিয়ার ছেলে আজ দেশে ফিরছেন, নির্বাচনে জয়লাভের জন্য বিএনপি তার উপর নির্ভর করছে।’’

তারেক রহমানের অসাম্প্রদায়িক ও উদারপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলে এই বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে চরমপন্থা বা উগ্রবাদ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। ‘‘আমি এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই যেখানে একজন মা তাঁর সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকবে’’ — তারেক রহমানের এই উক্তিটি দ্য হিন্দু এবং আল জাজিরা বিশেষভাবে আলোকপাত করেছে, যা তাঁর মানবিক ও কল্যাণকামী রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এনডিটিভি তাদের বিশ্লেষণে বলছে, তারেক রহমানের এই পরিকল্পনা কেবল নির্বাচন কেন্দ্রিক নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার এবং "বাংলাদেশ ফার্স্ট" নীতির একটি বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি যে "জাতীয় স্বার্থকে সবার উপরে" রাখার ঘোষণা দিয়েছেন, তা আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে।

এদিকে, ভারতীয় প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’ এক বিশেষ বিশ্লেষণে তুলে ধরেছে, তারেক রহমানের এই ফিরে আসা দিল্লির জন্য কেন তাৎপর্যপূর্ণ ও স্বস্তির খবর হতে পারে। ইন্ডিয়া টুডে’র মতে, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব এবং 'উগ্রপন্থী' শক্তির আস্ফালন দিল্লির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের ফেরা বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের উজ্জীবিত করবে, যা একটি গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়ক হতে পারে বলে মনে করছে দিল্লি। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন কেবল এদেশের মানুষের জন্যই নয়, ভারতের আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগ যখন নির্বাচন থেকে কার্যত দূরে এবং বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, ঠিক এমন মুহূর্তে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির পুনরুত্থানকে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছে ভারত।

‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’—কী সেই রহস্য?

তারেক রহমান তাঁর ভাষণে আমেরিকার কিংবদন্তি নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর ‘‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’’ বক্তব্যের আদলে যখন বলেন, ‘‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ফর দ্য পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি’’, তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে এই 'প্ল্যান' বা পরিকল্পনা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তারেক রহমান লন্ডনে থাকাকালীন গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের যে ইমেজ তৈরি করেছেন, তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিশ্ব গণমাধ্যমের এই অভূতপূর্ব কাভারেজে। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তারেক রহমানের ভিশন এখন বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর কাছে এক কৌতূহলের বিষয়।

বিমানবন্দর থেকে সমাবেশস্থল পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি এবং শৃঙ্খলার সাথে কর্মসূচি পালন বিশ্ব মিডিয়াকে অবাক করেছে। রয়টার্স ও এপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘ দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও জনসমর্থনের এই জোয়ার প্রমাণ করে যে, তারেক রহমানই বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি।

প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যমই ঢাকার বিমানবন্দর থেকে সমাবেশস্থল পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতির কথা তুলে ধরেছে। বিমানবন্দরে তারেক রহমানের খালি পায়ে মাটিতে পা রাখা এবং মৃত্তিকা স্পর্শ করার প্রতীকী ঘটনাটিও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতের মিডিয়াগুলো বিশেষ করে 'বাংলাদেশ ফার্স্ট' নীতি এবং তার প্রত্যাবর্তনের ফলে ভারতের সাথে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রকাশ করেছে।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন: