09/11/2025 ট্রাম্প মিত্র ও রক্ষণশীল ‘রকস্টার’ চার্লি কার্ককে গুলি করে হত্যা
মুনা নিউজ ডেস্ক
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:৪৯
ইউটাহের এক মনোরম কলেজের নীল আকাশের নিচে হাজার হাজার শিক্ষার্থী জড়ো হয়েছিল। তারা এসেছিল এমন একজন ব্যক্তির কথা শোনার জন্য। তিনি রক্ষণশীল ক্যাম্পাস রাজনীতিতে এক প্রকার ‘রকস্টার’ বলেই পরিচিত।
৩১ বছর বয়সী চার্লি কার্ক একটি তাঁবুর নিচে বসে ছিলেন।
পালাক্রমে মাইক্রোফোনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে বিতর্ক চলছিল তখন। লনের ওপরে জমায়েত হওয়া অনেকে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল, আবার কেউ কেউ প্রতিবাদও করছিল। কয়েক সেকেন্ড পরই গুলির শব্দে সবাই আতঙ্কে দৌড়াতে শুরু করে। ভিড়ের মধ্যে থেকে গুলি কার্কের গলায় গিয়ে লাগে।
পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ঘটনাটি ঘটছিল ক্যামেরার সামনে। এ ঘটনার ভয়াবহ ও রক্তাক্ত দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ডানপন্থী কর্মী ও ভাষ্যকার চার্লি কার্ক।
বুধবার ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। অতীতে কার্ক বহুবার সতর্ক করেছিলেন যে, তার সমালোচকদের কাছ থেকে সহিংসতার নানা হুমকি রয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্কের প্ররোচনামূলক রক্ষণশীল শৈলীর কারণে তার সমালোচকদের সংখ্যা প্রচুর। তবুও তিনি নিয়মিত কলেজ ক্যাম্পাসে যেতেন (যেখানে রাজনীতি প্রায়ই বামমুখী থাকে) এবং যে কেউ সামনে এলে তার সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতেন।
ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো সন্দেহভাজনকে শনাক্ত করতে পারেনি।
এফবিআই পরিচালক কাশ প্যাটেল জানিয়েছেন, এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছিল, পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
তিনি সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, আমাদের তদন্ত চলছে এবং স্বচ্ছতার স্বার্থে আমরা বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ অব্যাহত রাখব। ইউটাহ গভর্নর স্পেনসার কক্স এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, পুলিশ একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
ইউটাহর সাবেক কংগ্রেসসদস্য জেসন শ্যাফেৎজ ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, কার্ক ‘ট্রান্সজেন্ডার বন্দুকধারী ও গণহত্যায় অংশ নেওয়া বন্দুকধারীদের’ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় একটি গুলির আওয়াজ শোনা যায়। গুলি লাগার পর ৩১ বছর বয়সী কার্ক মাটিতে পড়ে যান। তার গলা থেকে রক্ত বের হয়ে আসতে দেখা যায়। খুব কাছ থেকে ধারণ করা এক ভিডিওতে বিষয়টি স্পষ্ট দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কাছের কোনো ভবনের ছাদ থেকে হত্যাকারী গুলি ছুঁড়েছে।
কার্ক ছিলেন অস্ত্র বহনের অধিকারের প্রবল সমর্থক ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের পক্ষপাতী, ট্রান্সজেন্ডার অধিকার নিয়ে সমালোচক এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প-সমর্থক।
চার্লি কার্ক টার্নিং পয়েন্ট ইউএসএ নামের একটি সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা। এটি যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষণশীল তরুণ-তরণীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন। গত নভেম্বরে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে তরুণ ভোটারদের সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সংগঠনটি। ২০১২ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আমেরিকা কামব্যাক ট্যুর’ নামে ১৫টি অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করেছিলেন চার্লি কার্ক। অক্টোবরের মধ্যে এই ১৫টি অনুষ্ঠান শেষ করতে চেয়েছিলেন তিনি। যে তাঁবুতে তাকে গুলি করা হয়, সেখানে বড় অক্ষরে লেখা ছিল ‘প্রুভ মি রং’ (আমাকে ভুল প্রমাণ করো)।
বিশেষত তরুণ রক্ষণশীল শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন নায়ক। তাদের কাছে গিয়ে তিনি নিজস্ব আন্দোলনের পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। কার্কের হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ বন্দুক-সহিংসতার আরেকটি অধ্যায় এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার ক্রমবর্ধমান ধারার সর্বশেষ ঘটনা।
এই বছরের শুরুতে মিনিসোটায় দুই ডেমোক্র্যাট অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতাকে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে গুলি করা হয়। তাদের একজন পরে মারা যান। গত বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর দুইবার হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে।
পেনসিলভানিয়ার বাটলার শহরে এক আউটডোর সমাবেশে ট্রাম্পের ওপর গুলি চলার ঘটনা এবং এই সপ্তাহের ইউটাহর গুলির ঘটনার চমকপ্রদ মিল রয়েছে। দুটি ঘটনাই প্রকাশ্যে মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঘটেছিল। তার দুই বছর আগে এক হামলাকারী হাতুড়ি নিয়ে তৎকালীন হাউস স্পিকার ও খ্যাতনামা ডেমোক্র্যাট ন্যান্সি পেলোসির বাড়িতে ঢুকে পড়েন। ২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার উত্তরের একটি বেসবল মাঠে অনুশীলনরত রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্যদের ওপর গুলি চালায় এক ব্যক্তি।
এখান থেকে আমেরিকার রাজনীতি কোনদিকে যাবে, তা অনুমান করা কঠিন, তবে গতি যে অন্ধকারের দিকেই—তা স্পষ্ট। সহিংসতা সহিংসতাকে ডেকে আনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিধ্বনি-কক্ষে বিভাজনমূলক বক্তব্য এবং সহজে অস্ত্র পাওয়ার সুযোগ ক্রমশ মানুষের মানসিক ক্ষোভ বাড়াচ্ছে আর রক্তক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
মিনিসোটা হামলার পর জনসমক্ষে উপস্থিতির নিরাপত্তা নিয়ে যেমন অনেক স্থানীয় রাজনীতিবিদ নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন, তেমনভাবেই এখন রক্ষণশীল কর্মীরাও জনসভা বা প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা পুনর্বিবেচনা করছেন। কিন্তু বাটলার শহরে ট্রাম্পের ওপর হামলার প্রচেষ্টা প্রায় সফল হয়েছিল। যদিও সেখানে স্থানীয় ও ফেডারেল নিরাপত্তা বাহিনী উপস্থিত ছিল। যদি এই ধারণা তৈরি হয় যে, কেউই নিরাপদ নয়, তাহলে তা আমেরিকার রাজনীতিতে ভয়াবহ ক্ষয় সৃষ্টি করবে।
গতকাল বুধবার রাতে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে হারিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি মুহূর্ত। চার্লি ‘সত্যের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।’ এ ঘটনায় ‘কট্টর বামপন্থীদের’ দুষছেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘(বামদের) বক্তব্য রক্ষণশীল এই কর্মীর মৃত্যুতে ভূমিকা রেখেছে।’
সাম্প্রতিক যেসব রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটেছে, বিশেষ করে যেগুলো রক্ষণশীলদের লক্ষ্য করে, তার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন এই হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী প্রতিটি ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবে।’
ট্রাম্পের এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে ডানপন্থী মহলে প্রশংসিত হবে। কারণ গুলির ঘটনার পরপরই তারা বামপন্থী সংগঠনগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। রক্ষণশীল কর্মী ক্রিস্টোফার রুফো এক্স-এ লিখেছেন, ‘আইনের সীমার মধ্যে থেকেই এখন সময় এসেছে, এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী সব ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করা।’
রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, উভয় দলের বহু প্রভাবশালী নেতা রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা জানাতে এবং উত্তপ্ত ভাষা কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে বুধবার সন্ধ্যায় কংগ্রেসে কার্কের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালনের পরপরই আইনপ্রণেতাদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যযুদ্ধ শুরু হয়, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে দলীয় বিভাজন এখনো তীব্র।
এদিকে ইউটাহে প্রত্যক্ষদর্শী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় নেতারা এই ভয়াবহতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সংবাদ সম্মেলনে আবেগপূর্ণ বক্তব্যে গভর্নর স্পেনসার কক্স দেশের অবস্থার কথা বর্ণনা করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এটাই কি সব? ২৫০ বছরের যাত্রা কি আমাদের এখানে এনেছে?’ তিনি নিজেই উত্তর দেন, ‘আমি প্রার্থনা করি যেন তা না হয়।’
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.