05/10/2025 ঢাকায় যমুনা-শাহবাগ অবরোধ থেকে ঘোষণা : আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ কর
মুনা নিউজ ডেস্ক
১০ মে ২০২৫ ০১:৫৪
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জোরালো হচ্ছে। মাঠ ছাড়ছেন না আন্দোলনকারীরা। একের পর এক ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। তারপর ‘সময় মঞ্চ’ থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ছড়িয়েছে আন্দোলন।
স্লোগান, বক্তব্য, মিছিলে ক্রমেই আন্দোলন সরকারের নজরে আসছে। আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কিছুটা ইতিবাচক সাড়াও পাওয়া গেছে। আন্দোলনকারীরা বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা রাস্তা ছাড়বেন না। শেষ রক্তবিন্দু ও একজন মানুষ রাস্তায় থাকলেও এই আন্দোলন চলবে।
ওদিকে উপদেষ্টা পরিষদের পরবর্তী বৈঠকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গেও পরামর্শ করা হবে।
বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে এনসিপি’র মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ’র ডাকে সাড়া দিয়ে যমুনার সামনে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। রাত ১টার দিকে মিছিল নিয়ে যমুনার সামনে যান এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তাদের সঙ্গে দলের কেন্দ্রীয় নেতারাও ছিলেন। রাত দুইটার কিছুক্ষণ আগে যমুনার সামনে মাইকে স্লোগান ধরেন নাহিদ ইসলাম।
এ সময় যমুনার আশপাশ স্ল্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে। ‘ব্যান করো ব্যান করো, আওয়ামী লীগকে ব্যান করো’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’ এবং ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, আওয়ামী লীগ নো মোর’। রাত ১টার পর হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু নেতাকর্মী যমুনার সামনে যান। তারা এনসিপি’র নেতাকর্মীদের পাশে থেকেই আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানান। রাত দেড়টার দিকে এবি পার্টির কিছু নেতাকর্মী সেখানে যোগ দেন। রাত ২টায় যোগ দেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা।
এ ছাড়া বিক্ষোভে যোগ দেন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, জুলাই ঐক্য, ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মীরাও। রাত গভীরের সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের জমায়েত বড় হতে থাকে। রাত ২টার পর কয়েক হাজার নেতাকর্মীর অবস্থান ও স্লোগানে উত্তাল হয় যমুনা এলাকা। রাতভর নেতাকর্মীরা সেখানেই অবস্থান নেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে যমুনার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে এই জমায়েতের ঘোষণা দেন এনসিপি’র দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও এনসিপি’র মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী।
শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে পাঁচটি পিকআপ ভ্যান একত্র করে সমাবেশের জন্য যমুনার পাশে ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পাশের ফোয়ারার সামনে ‘জমায়েত মঞ্চ’ করা তৈরি করা হয়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আয়োজিত এই জমায়েতে সবাইকে অংশ নেয়ার আহ্বানও জানান জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। মঞ্চের সামনেই আন্দোলনকারীরা জুমার নামাজ আদায় করেন। নামাজের পর বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশে নেতাকর্মীরা যোগ দিতে থাকেন। মহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার নেতাকর্মী সেখানে জড়ো হন। বিকাল পৌনে তিনটায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল সংলগ্ন সড়কে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে কর্মসূচি শুরু হয়। কোরআন তেলাওয়াত করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা আশরাফ মাহাদী।
সমাবেশ মঞ্চে অবস্থান ছিলেন এনসিপি নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম। ছাত্রশিবিরের সিবগাতুল্লাহ সিবগা, ফরহাদ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাসহ আরও অনেকে। তখন মঞ্চ থেকে স্লোগান আসে ‘কণ্ঠে আবার লাগা জোর, আওয়ামী লীগের কবর খোঁড়’, ‘গড়িমসি বন্ধ করো, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো’, ‘ব্যান ব্যান আওয়ামী লীগ, ‘লীগ ধর জেলে ভর’, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর, আওয়ামী লীগ নো মোর’। সমাবেশে এনসিপি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ইসলামী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। সাধারণ ছাত্র ও নাগরিকদেরও প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন হাতে যোগ দিতে দেখা যায়। কেউ কেউ মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে পৌঁছান। এরপর একে একে বক্তব্য দেন বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা।
আহত যোদ্ধা মাযহারুল ইসলাম আপন বলেন, আমরা কেউ ভালো নেই। এখনো আওয়ামী লীগের দোসররা ঘুরে বেড়াচ্ছে। জুলাই স্বীকৃতির ব্যাপারে কোনো লক্ষণ দেখছি না। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। জুলাই সনদ দিতে হবে। যতক্ষণ এটা না হচ্ছে ততক্ষণ আমরা যাচ্ছি না। জুলাই যোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মন বলেন, আমার মুখ ক্ষত। জুলাই আন্দোলনে এমন অনেক যোদ্ধা কমবেশি অনেক কিছু হারিয়েছেন আহত হয়েছেন, অনেকে শহীদ হয়েছেন। আমরা এর বিচার চাই। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করতে হবে। আমার সুস্থ হতে কতোদিন লাগবে সেটা সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। অনেক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠনে পাঁয়তারা চালাচ্ছে। আমাদের শরীরে বিন্দুমাত্র রক্ত থাকা পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে বাংলার মাটিতে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বিচার এবং নিষিদ্ধ না করা পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন থামবে না।
শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ শিমন্তি বলেন, যারা আহত-নিহত এদের সংখ্যা কী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের জন্য যথেষ্ট না? আওয়ামী লীগের ঠিকানা এই বাংলায় হবে না। তারা মিছিল করে এখনো। তারা কীভাবে এত সাহস পায়। যারা পালালো তারা কীভাবে পালালো? প্রত্যেকটা খুনির জনসম্মুখে ফাঁসি দেয়া হোক।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদী বলেন, ড. ইউনূস সাহেব যেদিন ক্ষমতায় বসেন সেদিন তিনি বলেছিলেন ছাত্ররা আমাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আজকে মনে করিয়ে দেই সারা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা আপনাকে বলছে, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবেন। সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে নির্বাহী আদেশে যে কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাহলে ছাত্রলীগের বাপ, মা আওয়ামী লীগকে কেন নিষিদ্ধ করা যাবে না। আপনাদের মাধ্যমে আসিফ নজরুল সাহেবকে একটা পরামর্শ দেই। জুলাই জনতা বেঁচে থাকতে বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনের ব্যালটে নৌকা মার্কা থাকবে না।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, বক্তব্য স্পষ্ট যতদিন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ না করা হবে ততদিন ঘরে ফিরে যাবো না। ড. ইউনূসের ক্যাবিনেটের সদস্যরা গাদ্দারি করছেন আমাদের সঙ্গে। আওয়ামী লীগকে পালাতে আপনারা সাহায্য করছেন। হাজারো আলেমকে নির্যাতন করেছে। আওয়ামী লীগ পিলখানা হত্যাকাণ্ড চালিয়ে জাতির সূর্য সন্তানদের হত্যা করেছে। ভারতের আগ্রাসনবাদী মতামতে গণহত্যা করেছে। এদেশের ছাত্রসমাজের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। যাদের অন্তরে আওয়ামী লীগের জন্য দুকদুক করছে তারা দিল্লি চলে যান। রাজপথ ছাড়বো না আওয়ামী লীগ খতম না হওয়া পর্যন্ত। ড. ইউনূস যতক্ষণ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা না দেবেন কেউ ফিরবে না।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, অবিলম্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রথম সংস্কার হলো আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এখানে দেখতে চাই। যারা আসবেন না, তারা তাদের পথ রচনা করবেন।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, গণহত্যাকারী দল হিসেবে আওয়ামীকে নিষিদ্ধ ও বিচার না করা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বেন না। আমাদের লড়াই মাত্র শুরু হয়েছে। যতক্ষণ-না আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা রাজপথ ছাড়বো না। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ১০০টা ফেরাউন একসঙ্গে করলেও একটা হাসিনা পাওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগকে কোন কারণে রাজনৈতিক দল বলা হয়? আমরা শুনতে পাচ্ছি প্রধান উপদেষ্টা নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে তিনি নাকি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
এনসিপি’র এ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ কোনোভাবে রাজনৈতিক দল নয়। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ বাকশাল তৈরি করে এ দেশে গণতন্ত্রের পরিবর্তে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছিল। আওয়ামী লীগের লুটপাটের কারণে দুর্ভিক্ষের কারণে ১৫ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের হাতে এ দেশের মানুষের রক্ত লেগে আছে। আওয়ামী লীগ ভারতের সহায়তায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যা করেছিল। তিনি আরও বলেন, ইন্টেরিমের কানে আমাদের দাবি পৌঁছায়নি। তাই আমরা সমাবেশস্থল থেকে শাহবাগ অবরোধে যাচ্ছি। দাবি না আদায় পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করবো।
হাসনাতের ঘোষণার পর বিকাল পৌনে ৫টার দিকে তারই নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ অবরোধ করেন। সেখানেও হাজার হাজার মানুষের মুখে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের স্লোগান। শুক্রবার বিকালে সরজমিন দেখা যায়, বন্ধ শাহবাগ মোড়। জনতারা দলে দলে ভাগ হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তাদের হাতে জাতীয় পতাকাসহ সারা বাংলায় খবর দে, আওয়ামী লীগের হবে না, সংবিধানে সংশোধনী আনো গণহত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত দল নিষিদ্ধের অনুচ্ছেদ সংযোজন করো, শাপলার খুনি আওয়ামী লীগের বিচার করতে হবে ইত্যাদি পোস্টার দেখা যায়।
আন্দোলনে জাতীয় নাগরিক পার্টি, ছাত্রশিবির, খেলাফতে মজলিস, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলনসহ অনেকে। আন্দোলনকারীরা মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। নামাজ তারা কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে আদায় করেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করেই তারা সড়ক ছাড়বেন।
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.