01/15/2025 "জুলাই ঘোষণাপত্র" নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কী?
মুনা নিউজ ডেস্ক
১৫ জানুয়ারী ২০২৫ ০৯:১৮
"জুলাই ঘোষণাপত্র" হিসেবে পরিচিত ছাত্র ও জনতার অভ্যুত্থানের দলিল ঘোষণার জন্য সরকারের ওপর আন্দোলনকারী ছাত্রদের চাপ থাকলেও রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করার পক্ষে সরকার।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার স্বীকৃতি ও সংবিধানে বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি এই ঘোষণাপত্রের অন্যতম লক্ষ্য।
ছাত্রদের পক্ষ থেকে বুধবারের মধ্যেই ঘোষণাপত্র প্রকাশের দাবির প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সাথে “একটি সর্বদলীয় বৈঠক” করে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশের সময় ঠিক করা হবে।
ওই বৈঠকের মধ্য দিয়ে “ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি দলিল প্রণীত হবে” আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “সেদিনই স্পষ্ট হবে কবে ঘোষণাপত্রটি জারি করব এবং সরকার কীভাবে ঘোষণাপত্র জারি করার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।”
গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে জানানো হলেও পরবর্তীতে ঘোষণাপত্র প্রকাশে ‘সহায়তা’র ঘোষণা দেয় সরকার।
ঘোষণাপত্রটি “হবে গণ-অভ্যুত্থানের একটি দালিলিক প্রমাণ। কোটা আন্দোলন থেকে কীভাবে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, কেন মানুষ জীবন দিয়েছে—সবকিছু উঠে আসবে,” জানুয়ারির শুরুতে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন নাগরিক কমিটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন।
সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে, গত জুলাই-আগস্টে যে ধারাবাহিকতায় গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, শিক্ষার্থীরা সেখানে তাদের “আদর্শিক জায়গা” স্পষ্ট করা এবং “গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে” ধারণ করার জন্যই ঘোষণাপত্রটি তৈরি করছে।
প্রসঙ্গত, ছাত্র আন্দোলন ও গণ অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার।
‘সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে হবে’
জুলাই ঘোষণাপত্র অন্তর্বর্তী “সরকারের শুরুতেই” প্রকাশ করা উচিত ছিল মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক কমিটির সহ-মুখপাত্র আরেফিন মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে সেই সদিচ্ছার অভাব এবং ঐক্যমত্য না থাকার ফলে সেটা হয়নি। ইতিমধ্যে পাঁচ মাস অতিক্রান্তও হয়ে গেছে।”
ঘোষণাপত্রটি ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রকাশের জন্য সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেবার যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ওই দিন সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনের প্রতিবেদন দেবার কথা রয়েছে। ফলে ঘোষণাগুলো যাতে বিভিন্ন কমিশনের প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়, তাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।
তবে ঘোষণাপত্রটি একটি “জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বড়ো একটা অভ্যুত্থানের দলিল,” উল্লেখ করে মঙ্গলবার মাহফুজ আলম বলেন, “এটা করতে সবাইকে সংযমের দিকে যেতে হবে।”
মতামতের জন্য সরকারের কাছ থেকে ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া পেয়েছেন জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “বিষয়টি এত বেশি সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা একদিনের নোটিশে মতামত দেওয়া সম্ভব না।”
তিনি বলেন, ঘোষণাপত্র নিয়ে “অন্যান্য দলগুলোর পাশাপাশি সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সাথেও কথা বলতে হবে। কারণ, এই ঘোষণাপত্রে সংবিধানের ব্যাপারেও কথাবার্তা আছে। সেগুলো আমাদেরকে দেখতে হবে।”
সরকারে কি অস্বস্তি?
অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের যে উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে ছাত্রদের সাত দফা দাবির মধ্যে নতুন সংবিধানের অঙ্গীকার রাখার দাবি রয়েছে।
জুলাই-আগস্টের শহীদদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, আওয়ামী লীগের বিচার, সংবিধান বাতিল করে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবিও রয়েছে জুলাই ঘোষণার সাত দফায়।
“আমরা বলছি, সংবিধান সংশোধন নয়, পুনর্লিখন করতে হবে। যেখানে জুলাই ঘোষণাপত্র যুক্ত থাকবে,” বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা।
তবে এই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকারের মধ্যে “এক ধরনের অস্বস্তি’ ও “সিদ্ধান্তহীনতা” লক্ষ করা যাচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরুল হুদা।
এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে সবগুলো দলের ঐক্যমত্যের অভাব দেখা যাচ্ছে।”
তাঁর মতে, বিএনপি নির্বাচনের দিকে মনোযোগী, ফলে তারা নির্বাচনমুখী সংস্কারের পক্ষে। বিএনপির মতো বড়ো দলগুলোর সম্মতি ছাড়া সংবিধান পুনর্লিখনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পদক্ষেপ, যেটা প্রক্লেমেশনে দাবি করা হচ্ছে, তা নেওয়া “সরকারের জন্য কঠিন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফার মতে, “জুলাই আন্দোলনে যারা সম্পৃক্ত ছিল, তারা একক কোনো দল নয়। এখানে নানা পথ, মত ও মতাদর্শের মানুষ ছিল। ফলে সবাই মিলে একক ঘোষণাপত্রে আসার যে চ্যালেঞ্জ সেটা বুঝতে পেরেছে সরকার।”
“সরকার হয়তো এই ঘোষণাপত্রের দায় নিতে চায় না। এ কারণে কম মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়,” তিনি উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, “১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র, একটা দেশে এর চেয়ে বড়ো কোনো ঘোষণা বা অঙ্গীকারের দরকার নেই। সাম্য প্রতিষ্ঠা, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে ওই ঘোষণাপত্রে।”
“গণতন্ত্র থাকলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ প্রতিটি মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয়। সেখানে মনোযোগ না দিয়ে নানা রকম বয়ান হাজির করার চেষ্টা করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
তবে ছাত্রদের ঘোষণাপত্রের সাথে “স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরোধ নেই,” বলে মনে করেন আলী রীয়াজ।
জুলাই ঘোষণাপত্র সংবিধানে যুক্ত করার দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে সংবিধান পুনর্লিখিত, সংশোধিত, সংযোজিত বা বিয়োজিত করার সময় নিশ্চয়ই ছাত্রদের এই দাবি বিবেচনায় নেওয়া হবে।”
বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাঁর কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে বলেও জানান তিনি।
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.