11/21/2024 ইসমাইল হোসেন সিরাজী : তার সাহিত্যে স্বাজাত্যবোধ
মুনা নিউজ ডেস্ক
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১২:২২
বাঙালি সমাজের এক যুগসন্ধিক্ষণে ইসমাইল হোসেন সিরাজীর জন্ম। বাঙালি কৃষ্টির কৃতিমান কবিশিল্পী। সতত বহমান জীবনধারারই ছবি সিরাজী সাহিত্যশিল্প। সিরাজী সাহিত্যে দ্রোহ আছে, আছে আমিত্ব-অহম, আছে মুক্তির ঠিকানা, আরো আছে দেশজ কৃষ্টির উদ্বোধন। সর্বোপরি ন্যায় ও মানবতাবোধ। ছিলেন অহির আদর্শের পুনর্জাগরণের প্রত্যাশী। মন ও মনন ছিল আসমানি আলোয় আলোকিত।
বিশ্বাসী বলে বলীয়ান বলেই তিনি বলতে পেরেছেন- ‘দাসত্বের জীবন যাপনের চেয়ে মৃত্যু সহস্্রগুণ উত্তম। কেন আমি পরাধীন দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। হে আল্লাহ! হয় স্বাধীন করো, নয় আমাকে গৌরবের মৃত্যু দাও।’ দেশ ও দশের প্রতি ছিল তার অসামান্য দরদ। এই সৎপ্রচেষ্টা থেকেই তিনি এই প্রার্থনা করেছেন। তার মৃত্যু গৌরবেরই। শত বছর পরে আজো জাতি তাকে ভোলেনি। আজো তিনি প্রেরণা, প্রেরণার বাতিঘর।
সিরাজী ছিলেন বাঙালির যুগ প্রতিনিধি। একজন সমাজ সচেতন কবির পক্ষেই সম্ভব সময়োপযুগী কবিতার রসায়ন সৃষ্টি। বাস্তবতার নিরিখেই তার প্রত্যাহিক প্রার্থনা : আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া, উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া, আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া, পূত বিভুু নাম স্মরণ করি, যুগল নয়ন করি উন্মীলন, কর চারিদিকে কর বিলোকন, অবসর পেয়ে দেখো শত্রুগণ, করেছে কী দৃশ অনিষ্ট সাধন, দেখো চাহিয়া অতীত স্মরি। (অনল প্রবাহ)
সাহিত্য সেবার মৌলিক লক্ষ্য ব্রিটিশ বিতাড়ন, জাতির জাগরণ, বাঙালি বিপ্লব, সর্বোপরি সুসত্যের সুপ্রতিষ্ঠা। সত্যের বন্দনায় মুখর। সত্য কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে তা তিনি স্পষ্ট করেছেন কবিতার ভাষায়- গো, মেষ, ছাগল, দুম্বা করিলে কোরবানি/পোহাবে না কভু এ দুঃখ রজনী। বিধি যে নিঠুর শক্ত-চাহেরে তোদের রক্ত/চাহে তিনি লক্ষ শির, প্রাণ দান/তবে পাবি স্বাধীনতা সুচির কল্যাণ। দীনের দাইয়ির দোয়া : উড়–ক অম্বরে পুনঃইসলামের বিজয় কেতন/দিকে দিকে উঠুক রে আল্লাহুর প্রমত্ত গর্জন/অই শুন মেঘ নাদে মহানবী ঘোপিছে কি বাণী/ লভি বিজয়নী শক্তি শত্রুশূন্য করহ অবনী। উপনিবেশবাদ উপড়ে ফেলতেই তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর- তোমার সাধের হেন্দে আজি তুমি বাকশক্তিহীন.../হে মোসলেম! চেয়ে দেখ কী ভীষণ দুর্দশা তোমার।
বাঙালি মনকে নাড়িয়ে তিনি লিখেছেন, ‘হারে! কুলাঙ্গার বঙ্গ মুসলমানি/নাহি কিরে কিছু ঘৃণ্য লজ্জা মান? ... জাগ তব সবে জাগ একবার/ আলস্য ঔদাস্য করি পরিহার।’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠবীর বখতিয়ার খলজির অমর বীরত্বগাথা মনে করিয়ে বাঙালির উজ্জীবন প্রার্থনা করেছেন- তোমার বিজয় স্মৃতি হৃদয়-মন্দিরে/জ্বলুক হে গাজী/মৃত্যুমুখ হতে পুনবঙ্গের মোসলেম/উঠুকরে আজি।’ ‘মেরুদণ্ডকে শক্ত করতে কবির আহ্বান : ওরে মূর্খ মুসলমান!/আছিস রে কিভাবে মগন/বাঁচতে চাহিস যদি/জাগ তবে জাগরে এখন।’ প্রত্যাশা করেছেন- নব আশে বীর বেশে/সাজুক রে দেশে দেশে/সিংহসূত মুসলমান আগ্নেয় উচ্ছ্বাসে/দীপ্ত হোক সারা বিশ্ব সৌভাগ্য বিভাসে হুঁশিয়ার করে।’ মুসলিমদের অতীত বর্তমান চরিত্রের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন মূর্ছনা কবিতায়- চরিত্র প্রভাবে যে মুসলমান, ছিল ধরাপূজ্য দেবতা সমান। রে চিরত্রহীন! কাপুরুষগণ, তোরা কিরে হায়। তাদের নন্দন?
মহাকবি কায়কোবাদ বলেছেন, ‘জ্ঞানের সাধনাই শ্রেষ্ঠ সাধনা।’ আল কুরআনের প্রথম বাণী, ‘ইকরা’ মানে পড়ো। মহানবীর প্রথম কাজই ছিল মানুষকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা। জ্ঞানের পূজারি কবি সিরাজী তাই বলেন, জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই ধরম, জ্ঞানই বিশ্বাস, জ্ঞানই মরম, জ্ঞানই ভক্তিমুক্তি, জ্ঞানই করম, এই মহামন্ত্র সার।’ জ্ঞান-বিদ্যায় দক্ষতা অর্জনে কবির তাগিদ- ভাই মোসলমান! নয়ন মেলিয়া উঠ একবার উঠরে জাগিয়া/আর কতকাল ওরে ভ্রাতৃগণ/বিঘোর নিদ্রায় রবে মগণ?/এ নিদ্রাবেশে রাজ্যধন গেল, সম্মান গৌরব সকলি ফুরাল, তাই বলি ভাই ওরে মুসলমান/বিদ্যা শিক্ষায় হও আগুয়ান।’ (আহ্বান) তিনি সে যুগেই উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।
জাতীয়তা সম্পর্কে ১৯১৩ সালে তিনি বলেন, ‘মুসলমানের জাতীয়তা মুসলমান ব্যতীত আর কিছুই হবে না। সমস্ত জগতের মুসলমান এক, ধর্ম এক, স্বার্থ এক, চিন্তা এক, কর্ম এক; ইসলামের এই মহাঐক্যের বন্ধনে সমস্ত নবীন যুবককে প্রমত্ত করতে হবে।’ পৃথিবীর প্রথম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়ক আবুবকরের আগে কোনো শাসক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয়েছে এমন প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। সিরাজী সেই আবুবকরের শাসনব্যবস্থা নির্মাণের প্রয়াসী।
বিশ্বাসী জাতি ঘোর হতমান। তারা ভুগছে পরিচয় সঙ্কটে। ভুগছে হতাশা-গ্লানিতে। ভুগছে আত্মদুশ্চিন্তায়। সিরাজী তাদের চেতনা ফেরাতে- আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া/উঠ রে মোসলেম উঠ রে জাগিয়া... (অনল প্রবাহ)
ঘুমন্ত জাতিকে জাগাতে তার প্রেরণা- হে মোসলেম! কতকাল, মোহঘুমে রহিবে পড়িয়া। বারেকের তরে কিহে উঠিবে না নয়ন মেলিয়া? অহির আলোয় ঝলমল উদগীরণ কবির উদাত্ত আবেদন- উদ্ধার করহ তব দস্যু-হৃত স্বর্ণ সিংহাসন। উড়ক অম্বরে পুনঃইসলামের বিজয় কেতন, দিকে দিকে উঠুক রে আল্লাহর প্রমত্ত গর্জন। (তুর্যধ্বনি)
অহমবোধে পরিপূর্ণ সাহিত্যকর্ম। বুকে ছিল অসীম তেজ ও সাহস। তাই তো লেখার স্পর্ধা- ‘আমি আলীর জুলফিকার খালেদের খড়গ/তরবারি বলে আমি জিনিব হে স্বর্গ।’ (পরিচয়) সোনালি অতীত স্মরণে গেয়েছেন- ‘গাব সে গৌরব কথা অতীত কাহিনী/নাচাইতে মোসলেমের নিস্পন্দ ধমনী।/গাব সে দুর্মাদ-বীর্য-দীপ্ত উন্মাদনা/কৃপা করি অগ্নিময় কর এ রসনা।’ ‘গৌরব কাহিনী-গাথা করুক স্মরণ/ গঠিত করুক সব জাতীয় জীবন। উঠুক গগনে পুনঃ সৌভাগ্য চন্দ্রমা/মোহিত করুক বিশ্ব ইসলাম সুষমা।’ (স্পেন বিজয় কাব্য)
এখনো কেন ভোরের আলো প্রস্ফ‚টিত হয়নি। সুবেহ সাদেক কেন বহুদূরে? ভাবুক কবির বেদনা- কোথায় তোদের বিজয়ী বাহিনী?/কোথায় তোদের গৌরব কাহিনী?/এলো কি ঘোর আঁধার যামিনী।/দেখি না গৌরব আলোক রেখা। (অনল প্রবাহ) মানস চেতনাকে জাগ্রত করার কবি বলছেন জাগরণী ভাষায়- এ বিশ্ব সংসারে বলো কি যে হায়!/তোদের মতন আপনা হারায়? তোদের তুলনা বিশাল ধরায়,/কিছুই তা নাহি করি দরশন/ হারায় কি অগ্নি দহন শকতি?/হারায় বিক্রম ভয়ে পশুপতি?/হারায় কি বিষ কভু বক্রগতি/হারায় কি বজ্র গভীর গর্জন?’
শুধু বাঙালি নয়, পুরো পৃথিবী নিয়েই তার কায়কারবার। কবির চিন্তা পৃথিবীকে নিয়েই- নিদ্রিত মোসলেম কবে উঠিবে জাগিয়া।/মেলিয়া যুগল আঁখি সিংহের মতন,/ আল্লাহু আকবার নাদে পৃথী কাঁপাইয়া/পূর্ণ অধিকার পুনঃ করিবে গ্রহণ।’ কিংবা ‘শত বজ্র ভীমনাদে গর্জুক অম্বর দেশে।/জাগুক মোসলেমগণ সর্বস্থানে সর্বদেশে।’ বদর, ওহুদ, খায়বার, খন্দকের চেতনাবহ্নিকেই জাগ্রত করার প্রয়াস- গাজী ভিন্ন লোকজন এ যুগে পাবে না ত্রাণ/প্রাণ দানে অশক্ত যে, সে ত নহে মুসলমান।’ মুক্তির পথ এভাবেই বাতলে দিয়েছেন কবি।
দীনের উত্থান না হওয়ায় কবির কী যে আর্তনাদ- দিন মাস বর্ষে হায়!/আজি কত যুগ যায়।/আর কি ইসলাম রবি হবে না উদিত? (দীপনা) একই সাথে ঈমানদারদের প্রতি দায়িত্ব গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান- ‘উঠ তবে ভাই! উঠ মুসলমান,/জাগ তবে সবে ধরি নব প্রাণ,/সাধহ কর্তব্য রাখিবারে মান,/এখনি নিশার হবে অবসান।/দারিদ্র্যের জ্বালা হবে তিরোধান,/ফিরিবে অতীত গৌরব সম্মান/ত্বরা সুখ-রবি উদিবে হাসি।’ (অনলপ্রবাহ)
মহাকবি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে বুঝতে হবে ঔপনিবেশিক বিরোধিতার বাস্তবতায়। বিশ শতকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের উজ্জীবন, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এবং স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা, আকরম খাঁ, নজরুল ইসলামের মতো যুগনায়কদের আবির্ভাব প্রভৃতি প্রসঙ্গের অনিবার্যতায় সিরাজী সাহিত্যের তত্ত¡ তালাশ অপরিহার্য। একই সাথে সমকালীন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট, জমিদারি ও মহাজনি শোষণ প্রক্রিয়ার যথার্থ জ্ঞানচর্চা আবশ্যক। বঙ্কিমচন্দ্রের বৈরী সাহিত্য প্রসঙ্গও প্রণিধানযোগ্য। সিরাজী পাঠে এসব বিবিধ বিষয় পাঠকের বিবেচনাধীন থাকবে। বাঙালির নিত্য ভাবনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠুক সিরাজী। তাহলেই বাঙালির চিন্তাজগৎ পরিচ্ছন্ন ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.