04/03/2025 শিকাগো'র হে মার্কেটে রক্তভেজা সেই দিনটি : মে দিবসের উৎপত্তি যেভাবে
মুনা নিউজ ডেস্ক
১ মে ২০২৩ ১২:০৯
দিনটা ১৮৮৬ সালের ৪ মে। কর্মঘণ্টা ও মজুরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের অসন্তোষ তখন চরমে। দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা, এমনকি তারও বেশি সময় হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে মিলত নামমাত্র মজুরি। এ নিয়ে চলছিল বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং। শ্রমিকদের দাবি, দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মসময়, আর সংসার চালাতে একটু ভালো মজুরি। তবে তা মানতে নারাজ মালিকপক্ষ।
শ্রমিকদের এ বিক্ষোভ দানা বাঁধা শুরু করেছিল সে বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে। দাবি পূরণের জন্য মালিকপক্ষকে ১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন শ্রমিকেরা। তবে তাঁদের নিরাশ হতে হয়। জবাবে সেদিন কাজ বাদ দিয়ে শিকাগোর মিশিগান অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন হাজারো শ্রমিক। গলা মিলিয়ে তাঁদের স্লোগানে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা, ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আট ঘণ্টা আমাদের নিজেদের জন্য।’ কোনো সংঘাত ছাড়াই সেদিনের বিক্ষোভ শেষ হয়।
এক দিন বাদে ঘটনা মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। আন্দোলনে প্রথম রক্ত ঝরে শ্রমিকদের। সেদিন ৩ মে। শিকাগোর ম্যাককরমিক রিপার ওয়ার্কসের শ্রমিকদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ বাধে পুলিশের। গর্জে ওঠে পুলিশের বন্দুক। প্রাণ যায় দুজনের। সেদিন সন্ধ্যায় এ হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদ জানাতে পরদিন সন্ধ্যায় হে মার্কেট চত্বরে ওই সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন এক দল শ্রমিক।
এল ৪ মে। যথারীতি শ্রমিকেরা জড়ো হয়েছিলেন হে মার্কেট চত্বরে। এ সমাবেশ ঘিরে সতর্ক ছিলেন শিকাগোর মেয়র কার্টার হ্যারিসন। বিপুলসংখ্যক পুলিশ নিয়ে তিনিও হাজির হয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ভেবে সেখান থেকে চলে যান মেয়র। ঝড়বাদলের পর শেষ ভাষণ দিতে ওঠেন একজন শ্রমিকনেতা। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে গলা চড়িয়ে বলেন, ‘আইনের ওপর আপনারা চোখ রাখুন...একে থামিয়ে দিন।’
মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুজনের সাজা কমানো হয়। বাকিদের মধ্যে চারজনকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয়। আরেকজন ফাঁসির আগের দিন রাতে কারাগারের ভেতরেই নাটকীয়ভাবে আত্মহত্যা করেন।
এ ঘোষণায় উসকানির গন্ধ পায় পুলিশ। এগিয়ে যায় আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে। তখনই আকাশ কাঁপিয়ে বিস্ফোরণ, আলোর তীব্র ঝলকানি আর ধোঁয়া। এরপর গুলি। ঘটনা চোখে দেখা অনেকের দাবি, বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশ আতঙ্কিত হয়ে গুলি চালায়। এই গুলির শিকার হয়েছিলেন শ্রমিকদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও। অপরদিকে পুলিশের দাবি ছিল, গুলি চালিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা। তবে সত্যটা যা–ই হোক না কেন, সেদিন গোটা হে মার্কেট এলাকায় নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। সংঘর্ষে আহত হন প্রায় ৬০ জন পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে সাতজনকে বাঁচানো যায়নি। নিহত হন অন্তত চারজন শ্রমিক। আহত অগুনতি।
সেখানে ভয়াবহ ওই সংঘাতের পর গোটা শিকাগোয় জারি হয় সামরিক আইন। গ্রেপ্তার হন শত শত মানুষ। তবে এত কিছুর পরও কে আসলে বোমা হামলা চালিয়েছিলেন, তা থেকে যায় ধোঁয়াশায়। শেষ পর্যন্ত আটজনের বিরুদ্ধে হে মার্কেট চত্বরে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। ১৮৮৬ সালের আগস্টে আদালত তাঁদের সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেন। একজন পান ১৫ বছরের কারাদণ্ড। পরে অবশ্য মৃত্যুদণ্ড পাওয়া দুজনের সাজা কমানো হয়। বাকিদের মধ্যে চারজনকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ফাঁসি দেওয়া হয়। আরেকজন ফাঁসির আগের দিন রাতে কারাগারের ভেতরেই নাটকীয়ভাবে আত্মহত্যা করেন।
এ ঘটনার জেরে ১৮৮৯ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে মে মাসের প্রথম দিন বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের জন্য ছুটি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই দিনটিই আজ পরিচিত মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে। হে মার্কেটে শ্রমিকদের রক্তে ভেজা সেই দিনটির প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হয়।
তবে অবাক করা বিষয় হলো, যে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলন ঘিরে মে দিবসের উৎপত্তি, সেখানেই এই দিনটি পালিত হয় না। কারণটা খুঁজতে আবার যেতে হবে অতীতে। গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রবিরোধী চেতনা চরমে ওঠে। তখন দেশটিতে শ্রমিকদের এই ছুটিকে দেখা হতো বাঁকা চোখে। এ নিয়ে ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার একটি প্রস্তাবে সই করেন। সেখানে মে মাসের প্রথম দিনকে আনুগত্য দিবস ঘোষণা করা হয়। তবে দেশটিতে কিন্তু আলাদা একটা শ্রমিক দিবস আছে। সেটা সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার।
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.