11/23/2024 সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ বাংলাদেশ : গবেষণা
মুনা নিউজ ডেস্ক
২৯ আগস্ট ২০২৩ ১১:৫৪
বাংলাদেশে বায়ু দূষণের উচ্চ মাত্রা সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি আর ছোট-বড় অজস্র নির্মাণ কাজের ফলে রাস্তাঘাটে ধুলো-বালির স্তূপ, ইটের ভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, আবর্জনা পোড়ানো, কিংবা গ্রামে-গঞ্জে রান্নার কাজে ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া ইত্যাদি নানা কারণেই বাংলাদেশের বাতাস অনেক দিন ধরেই দূষিত।
আজ, ২৯ আগস্ট, মঙ্গলবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বায়ু দূষণের বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ। এই দূষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় ৬.৮ বছর। এলাকাভেদে এই পরিস্থিতি আরো করুণ।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুরে দেশের সবচেয়ে ‘দূষিত' জেলা এবং বায়ু দূষণের কারণে এই জেলায় বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে ৮.৩ বছর।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট বৈশ্বিক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স, ২০২৩ এই শিরোণামে।
প্রতিবেদনের জন্য মূলত স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ২০২১ সালের বাতাসের গুণমান বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যা্চ্ছে প্রতি ঘনমিটারে বাতাসে সর্বোচ্চ যে দূষণ কণা মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি তার চাইতে ১৪ থেকে ১৬ গুণ বেশি।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ১৫ মাইক্রোগ্রামকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী এসব গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৭০ থেকে ৮০ মাইক্রোগ্রাম, যা দেশ হিসেবে বিশ্বে সর্বোচ্চ, যদিও ভারতের উত্তর সমতল, বিশেষত রাজধানী দিল্লীর আশেপাশে এরকম কণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ১২৬ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত মানের চেয়ে প্রায় ২৫ গুণ বেশি।
‘‘যদিও কিছু ভারতীয় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেয়, সামগ্রিকভাবে সবচেয়ে দূষিত দেশ বাংলাদেশ’’ - শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমনকি বাংলাদেশের সবচেয়ে কম দূষিত যে জেলা সেই সিলেটেও কণা দূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়ে ৯.৭ গুণ এবং জাতীয় মানের ৩.২ গুণ বেশি বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনটি। গড় আয়ু বিবেচনা, বায়ু দূষণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হৃদ রোগের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে প্রতিবেদনটি উল্লেখ করেছে। এর প্রভাব ধুমপানের চেয়ে মারাত্মক। তামাক সেবনের কারণে গড় আয়ু যেখানে কমে যাচ্ছে ২.১ বছর, যখন শিশু এবং মাতৃ অপুষ্টি গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে ১.৮ বছর, বায়ু দূষণের প্রভাব দেখা যাচ্ছে এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি।
বায়ু দূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ুতে সবচাইতে বেশি প্রভাব পড়ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এই দুটি অঞ্চলে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের বসবাস। দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশেরও বেশি এই অংশটি গড় আয়ু হারাচ্ছে ৭.৬ বছর। বাংলাদেশ যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী বায়ু দূষণ কমিয়ে আনতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনবহুল জেলা ঢাকার বাসিন্দাদের আয়ু বেড়ে যাবে ৮.১ বছর।
বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সবচাইতে দূষিত দেশ বললেও গবেষকরা জানিয়েছেন ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ২.২ শতাংশ কমেছে যদিও এর কোনো কারণ তারা উল্লেখ করেননি।
তবে বাংলাদেশের স্থানীয় বিশেজ্ঞরা বলেছেন, কোভিডকালীন লক ডাউনের কারণেই মূলত সেসময় সাময়িক কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে ২০২২ সালে কোভিড পরবর্তী সময়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আবার বায়ু দূষণ বেড়েছে বলেই তারা জানিয়েছেন।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেয়ারিক পলিউশন স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার মনে করেন, বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবের ফলেই এক্ষেত্রে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
তিনি ইটের ভাটা এবং শিল্প কারখানায় যে বায়ু দূষণ হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাজ করার কথা বলেছেন। আবার নির্মাণ কাজের যে বায়ু দূষণ হয়, গৃহায়ন বা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বা রাজউককে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলছেন। আবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলে যে দূষণ হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কিংবা সিটি কর্পোরেশনকে কাজ করার কথা বলেছেন। "এখানে মাল্টি মিনিস্ট্রিয়াল কিছু বিষয় আছে। ফলে বায়ু দূষণের কাজটিও মাল্টি মিনিস্ট্রিয়াল বা সমন্বিতভাবে করতে হবে। সকলের সম্মিলিত বা অংশীদারিত্বমূলক চেষ্টা থাকলেই বায়ু দূষণ কমবে,"- বলেছেন অধ্যাপক অধ্যাপক কামরুজ্জামান ।
তবে এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যে ভূমিকা পালন করছে, তাতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এই দূষণ বিশেষজ্ঞ। "যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন, তারা দৃশ্যমান টেকসই কোনো সমাধান তৈরি করতে পারেননি। যখনই বায়ু দূষণ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়, কিংবা টিভিতে রিপোর্ট হয়, তখন আমরা কয়েকটি ক্ষেত্রে এনফোর্সমেন্ট লক্ষ্য করি। সেটি মূলত ইটের ভাটার বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট, কারণ, ইটের ভাটাগুলো এক জায়গায় আছে, স্থায়ী ঠিকানায় আছে। এদেরকে গিয়ে ধরা যায়।
‘‘কিন্তু যানবাহন থেকে যে বায়ু দূষণ হয়, ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে বায়ু দূষণ হয় কিংবা বড় বড় প্রকল্প থেকে যে বায়ু দূষণ হয়, সেক্ষেত্রে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা আমরা লক্ষ্য করি না। দুই একবার মেগা প্রকল্পগুলোকে আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর জরিমানা করতে দেখেছি, কিন্তু এরপর আর কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি।’’
দূষণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে চীনকে উদাহরণ হিসেবে মানছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। ২০১৩ সালে ‘দূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে চীন। এর ফলে গত এক দশকে চীনের দূষণ কমেছে ৪২.৩ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এরকমই একটা যুদ্ধ প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র : ডয়চে ভেলে
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.