12/08/2025 ভারতের কাছে চীনা রোবটের গুপ্তচরবৃত্তি, ভাইরাল ক্লিপ নিয়ে জল্পনা
মুনা নিউজ ডেস্ক
৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:৩২
ভারতীয় সেনার গতিবিধি পর্যবেক্ষণে সীমান্তে ‘গোয়েন্দা রোবট’ মোতায়েন করেছে চীন। সম্প্রতি এমন জল্পনা চাউর হয়েছে। এই জল্পনার নেপথ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ক্লিপ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব রোবট দেখে মনে হবে ঠিক যেন রক্ত-মাংসের মানুষ। কথাবার্তা ও হাঁটাচলা এতটাই সাবলীল যে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে এর পার্থক্য বোঝার জো নেই! এই অত্যাধুনিক যন্ত্রমানবের সাহায্যে এ বর ভারতীয় সেনার গতিবিধির উপর নজরদারি চালাচ্ছে চীন।
মনুষ্যরূপী রোবটগুলোকে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসিতে (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) মোতায়েন করেছে বেইজিং। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল ওই ভিডিওকে ঘিরেই তুঙ্গে উঠেছে এমন জল্পনা।
চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ভারত-চীন সীমান্তের একটি ভিডিও শেয়ার করেন জুনশিগুয়ানচা নামের এক নেটিজেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ৩৩ সেকেন্ডের ক্লিপটি ভাইরাল হয়ে যায়। পোস্টে জুনশিগুয়ানচা লেখেন, ‘‘নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে এই ভিডিও পেয়েছি। এলএসিতে নজরদারি ডিভাইসের সাহায্যে আমাদের বাহিনীর উপর গুপ্তচরবৃত্তি করছে চীন।’’
এরপরই সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বিভিন্ন রকমের মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারীরা।
এক্স হ্যান্ডল থেকে ভাইরাল হওয়া ৩৩ সেকেন্ডের ওই ক্লিপে সাদা পোশাক পরিহিত অবস্থায় একটি যন্ত্রমানবকে দুর্গম পাহাড়ি ভূখণ্ডে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। ভিডিওতে কাউকে হিন্দিতে কথা বলতে শোনা গেছে। তবে সেটা মনুষ্যরূপী রোবটের কণ্ঠস্বর কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। ভিডিওটি প্রায় ৩,৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এলএসির কোথায় এবং কবে তোলা হয়েছে, তা-ও জানা যায়নি।
নেটিজেনদের একাংশ অবশ্য কথিত চীনা গুপ্তচর রোবটকে বিজ্ঞানভিত্তিক ছায়াছবির অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। কারও আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন মত রয়েছে। তাদের দাবি, অরুণাচল প্রদেশ বা লাদাখের কাছে নিয়মিত টহলের সময় ভারতীয় সৈনিকদের নজরে পড়ে বেইজিংয়ের ওই যন্ত্রমানব। তবে অধিকাংশ সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারী একে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নির্ভর ভিডিও বলে দাবি করেছেন।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বছরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে যন্ত্রমানব নির্মাণে অভূতপূর্ণ সাফল্যের কথা জানিয়ে চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পেতেই বিশ্বজুড়ে শুরু হয় হইচই। ওই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই এলএসিতে কথিত মনুষ্যরূপী গুপ্তচর রোবটের ভিডিও সামনে আসায় বিষয়টিকে একেবারেই হালকাভাবে নিচ্ছেন না ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও। তাদের দাবি, ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’য় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তুলতে দিল্লির আরও বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন।
চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৬ নভেম্বর যন্ত্রমানবের সফল পরীক্ষা চালায় সাংহাইয়ের সংস্থা ‘অ্যাজিবট’। তাদের তৈরি মনুষ্যরূপী রোবটটি চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুঝোর জিনজি হ্রদ থেকে সাংহাইয়ের বুন্ড পর্যন্ত ১০৬ কিলোমিটার বিরামহীনভাবে ট্রেক করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। শুধু তা-ই নয়, একটানা লম্বা রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দ্বিপদ যন্ত্রটির নাম উঠে গেছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও।
‘অ্যাজিবট’ জানিয়েছে, তাদের তৈরি মনুষ্যরূপী যন্ত্রমানবটির উচ্চতা ১.৭৫ মিটার (৫.৭৪ ফুট) এবং ওজন প্রায় ৫৫ কিলোগ্রাম। রোবটটিতে উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেছে নির্মাণকারী সংস্থা। যন্ত্রমানবটিতে রয়েছে মোবাইল ফোন বা পাওয়ার ব্যাংকের লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। সেখান থেকেই শক্তি নিয়ে ১০০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা হাঁটতে পেরেছে সেটি।
সাংহাইয়ের ‘অ্যাজিবট’ সংস্থাটি দীর্ঘ দিন ধরেই রোবট তৈরি করে আসছে। কোম্পানির নামেই মনুষ্যরূপী যন্ত্রমানবটির নাম ‘অ্যাজিবট এ২’ রেখেছে তারা। সংশ্লিষ্ট মেশিনে রয়েছে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টম) এবং ইনফ্রারেড ডেপথ ক্যামেরা। প্রথমটি রোবটটিকে পথ দেখিয়ে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়টির সাহায্যে সূর্যের আলো স্থানান্তরিত করে শহুরে বাধাবিপত্তি আয়ত্ত করে নিয়েছে ‘অ্যাজিবট এ২’।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারের কুচকাওয়াজে রোবট-কুকুর প্রকাশ্যে এনে সারাবিশ্বের নজর কাড়ে চীনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। একই ধরনের যন্ত্র রয়েছে ভারতীয় সেনার বহরেও। সারমেয়রূপী যন্ত্রগুলোর উপর মেশিনগান বসিয়ে তার থেকে দিব্যি গুলি ছুড়তে পারেন ভারতীয় সৈনিকেরা। এছাড়া নভোচর যন্ত্রমানবী রয়েছে নয়াদিল্লির মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন’ বা ইসরোর হাতে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, মনুষ্যরূপী সেনা যন্ত্রমানব নির্মাণের থেকে খুব একটা দূরে নেই ভারতও। যদিও কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তির নিরিখে নয়াদিল্লির থেকে বেইজিং এগিয়ে আছে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন তারা। সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের কথায়, যেকোনও জটিল প্রযুক্তিকে বাহিনীতে শামিল করতে সময় লাগে। নভেম্বরের পরীক্ষায় সাফল্য পাওয়ার পরই সংশ্লিষ্ট রোবটটিকে পিএলএ-র পক্ষে এলএসির মতো সংবেদনশীল এলাকায় মোতায়েন করা বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন তারা।
২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় পিএলএ-র সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারান কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন ভারতীয় সৈনিক। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ দেশের বাহিনীর প্রত্যাঘাতে মৃত্যু হয়েছিল ৪০-এর বেশি চীনা সেনাবাহিনী। যদিও সরকারিভাবে কখনওই সে কথা স্বীকার করেনি বেইজিং। ওই ঘটনার প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। ড্রাগনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কেও হ্রাস টানে নয়াদিল্লি।
গালওয়ান সংঘর্ষের পর উভয়পক্ষই এলএসিতে বিপুল সংখ্যক সৈনিক ও হাতিয়ার মোতায়েন করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের পর কূটনৈতিক পথে সংশ্লিষ্ট সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয় দু’পক্ষ।
এ বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র বৈঠকে যোগ দিতে চীন সফরে যান প্রধানমন্ত্রী মোদি। সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তার। সে সময় সীমান্ত সংঘাত মিটিয়ে ফেলার আশ্বাস দেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
গালওয়ান সংঘাতের পর ভারত-চীন সরাসরি বিমান চলাচল বন্ধ ছিল। গত নভেম্বরে ফের তা চালু করা হয়। তবে বিবাদ যে একেবারে মিটে গেছে এমনটা নয়। সম্প্রতি সাংহাই বিমানবন্দরে ট্রানজিটের সময় অরুণাচল প্রদেশের এক নারীকে ১৮ ঘণ্টা ধরে আটকে রাখার অভিযোগ ওঠে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে ফের কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়ায় দুই প্রতিবেশী দেশ।
দীর্ঘ দিন ধরেই অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে আসছে চীন। সাংহাই বিমানবন্দরে আটকে পড়া ভারতীয় ওই নারীর অভিযোগ, কেন তিনি চীনা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেননি, সে কথা জানতে চান সেখানকার কর্মকর্তারা। অবৈধভাবে অরুণাচল প্রদেশকে দখলে রাখা হয়েছে বলেও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে শোনা গেছে তাদের।
এই পরিস্থিতিতে এলএসিতে যন্ত্র-রোবট বা কোনও ডিভাইসে ভারতীয় সেনার গতিবিধির উপর গুপ্তচরবৃত্তির খবর নিঃসন্দেহে নয়াদিল্লির কপালে ফেলেছে চিন্তার ভাঁজ। তবে ভাইরাল ভিডিওটি নিয়ে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনও বিবৃতি দেয়নি ভারতীয় সেনাবাহিনী। ফলে পাল্টা প্রস্তুতি হিসেবে সীমান্তে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
A Publication of MUNA National Communication, Media & Cultural Department. 1033 Glenmore Ave, Brooklyn, NY 11208, United States.